২০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০
মৌনী মুক্তা চক্রবর্তীর চিত্র প্রদর্শনীর বিশেষ আয়োজন

সুরের মূর্চ্ছনায় ক্যানভাসে মূর্ত হওয়া পাতা ঝরা বিকালের গল্প

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

সুরের মূর্চ্ছনায় ক্যানভাসে মূর্ত হওয়া পাতা ঝরা বিকালের গল্প

সমুদ্রের নীলজলে সফেদ ফেনা, বিকেলের গোধূলির রঙের আভা আর জীবন নৌকার বিমূর্ত চিত্রকর্ম দেখে নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর বলছিলেন, আসলে তার আঁকায় একটা অদ্ভুত ধ্রুপদী সাঙ্গীতিক বিষয় আছে। চিত্রশিল্পী মৌনী মুক্তা চক্রবর্তীর মাসব্যাপী চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে এই কথাগুলো বেশ আবেগ নিয়েই বলেছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত এই অভিনয় শিল্পী। 

আর গত ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় যেনো সেই কথারই মঞ্চায়ন হয়ে গেলো ব্রাডি আর্ট সেন্টারে। ছবি কিংবা সঙ্গীতের কোন নিজস্ব ভাষা নেই! সারা পৃথিবীময় তাদের বিচরণ। তাইতো ক্যানভাসে যখন মৌনি মুক্তা চক্রবর্তীর তুলি আচড় ফেলে মূর্ত করছিল গোধূলী রঙ্গে পাতা ঝরা একটি বিকেলের গল্প তখন শেতাঙ্গ সংগীত শিল্পী গ্যারি কফলান গিটারের সাথে বাংলার ঢোল ঢপকি নিয়ে নাজিম উদ্দিন, অসীম চক্রবর্তী আর তৃষা ভট্রাচার্য্য গলা ছেড়ে গাইছিলেন, কোন মেস্তরী নাও বানাইলো... গানের তালে তালে আবার নাচছিলো ছোট বড় সবাই। ভিনদেশী দর্শকরা গানের তাল উপভোগ করেছেন, মাথা দুলিয়েছেন আবার মুগ্ধ নয়নে দেখেছেন একজন বঙ্গ ললনা’র তুলি ক্যারিশমা! 

চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠলো একটি পাতা ঝড়া বিকালের শব্দ! মৌনি মুক্তা চক্রবর্তীর মাসব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীর বিশেষ এই আয়োজনটি আরো বিশেষ হয়ে উঠেছিলো অন্য এক কারণে। ব্রিটেনের বাংলা সাংস্কৃতিক জগতে নতুন প্রজম্মেও কোন আগ্রহের জায়গা তৈরি করা যায়নি বলেই তারা তেমন আগ্রহী হয়ে উঠেনা এমনসব আয়োজনে। তবে পরিবেশনার মুন্সিয়ানায় “ত্রিবেনী”র আয়োজন সফল হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক নতুন প্রজম্মের উপস্থিতি ছিল সেদিন। তারা আগ্রহভরে দেখেছে রং তুলির খেলা, সেই সাথে শুনেছে ফিউশন মিউজিক।

গত পহেলা নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া চিত্র শিল্পী মৌনী মুক্তা চক্রবর্তীর একক চিত্র প্রদর্শনী "ত্রিবেণী: দ্য রিদম অফ ওয়াটার'-এর কথা। লন্ডন বারা অফ টাওয়ার হ্যামলেটের মাস ব্যাপী সিজন অফ বাংলা ড্রামা ফেস্টিভ্যালের অংশ হিসাবে একই দিনে শুরু হওয়া এই চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর (এমপি )। প্রদর্শনীতে স্থান পায় মৌনী মুক্তা চক্রবর্তীর আঁকা চল্লিশটি চিত্রকর্ম। উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে জল রং এবং এক্রেলিক রঙে আঁকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দুইটি প্রতিকৃতি , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি এবং সব্যস্যাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের একটি প্রতিকৃতি সহ প্রায় এগারোটি প্রতিকৃতি । সেই সাথে আছে বাংলাদেশ এবং লন্ডনের বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপ এবং ঘোর লাগানো বিমূর্ত (এবস্ট্রাক্ট) পেইটিং।

তৃতীয় সপ্তাহেও ছিলো দেশি বিদেশী শিল্প অনুরাগীদের চোখে পড়ার মতো আনাগোনা। প্রতিটি কাজের ভূয়সী প্রশংসা জমা পড়েছে মন্তব্য খাতায়, মিলে দর্শকদের অভূতপূর্ব সাড়া।
প্রদর্শনী ঘুরে এসময়ের জনপ্রিয় কবি শামীম আজাদ বলেন "আমাদের প্রিয় মৌনীর চিত্র প্রদর্শনী দেখে আমি মুগ্ধ! তাতে আছে নারী অভিব্যক্তির পরম্পরা, মানুষের মানসিকতার মুহূর্ত বিভাজন, রঙের বাহাদুরী ও আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতির জনকের প্রতিকৃতি। প্রতিটি কাজে ফুটে উঠেছে শিল্পীর অভিনিবেশ ও নিষ্ঠা।

অভিনেত্রী, লেখক এবং চলচিত্র নির্মাতা লিসা গাজী প্রতিটি চিত্রকর্মের ভূঁয়সী প্রশংসা করে বলেন, মৌনী মুক্তা'র প্রতিটি কাজে বাংলাদেশের রং বিদ্যমান। প্রতিটি চিত্র মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়।

কুইনমেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এলিস্টার ক্যাম্পবেল বলেন, মৌনী মুক্তা'র পেইন্টিংয়ে একধরণের ম্যাজিক আছে যা দর্শককে খানিক্ষনের জন্য থামতে বাধ্য করে। চিন্তাশক্তি কে উস্কানি দেয় চিত্রকর্মেও রং এবং বিষয় বস্তু নিয়ে চিন্তা করবার জন্য। ব্রিটিশ পরিবেশবিদ মিস্টার মুসগ্রোভ বলেন, চমৎকার আয়োজন এবং নামের সাথে অদ্ভুত মিল। ত্রিবেণী মানে তিনটি নদীর মিলনস্থল। চিত্র শিল্পী মৌনী মুক্তা যেনো বাংলাদেশের তিনটি নদীর বিমূর্ত রূপ গুলো তুলে এনেছেন সুদূর ব্রিটেনে। তিনি আরো বলেন এধরণের শিল্প কর্ম জলবায়ু রক্ষার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে বেগবান করা সম্ভব।

এক্সিবিশন হল ঘুরে দেখে লন্ডনে বসবাসরত ফরাসি অভিনেত্রী 'এস'রা সিসে' বলেন প্রতিটা কাজের আলাদা আলাদা বৈচিত্র থাকলেও কোথাও যেনো প্রতিটা কাজই একটা অদৃশ্য সূত্রে গাঁথা, এবং এটাই একজন চিত্র শিল্পীর স্বার্থকতা। শত বৈচিত্রেও নিজের স্বতন্ত্র চিন্তা এবং ভাবনাকে খুবই সতর্ক ভাবে মেলে ধরা, যাতে নিজের আলাদা এই ভাবনা বৈচিত্রটাকে অতিক্রম না করে আবার স্বতন্ত্রতাও বজায় থাকে।

চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতেই রবিবার বিকেলে ছিলো 'লাইভ ব্লেড অফ আর্ট, মিউজিক এন্ড পার্কেশন' শিরোনামে একটি লাইভ আর্ট এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংগীতিক পরিবেশনা। নদীভিত্তিক শিল্প ও সাহিত্য বিষয়কে উপজীব্য করে অসীম চক্রবর্তীর রচনা ও নির্দেশনায় লাইভ আর্ট এন্ড মিউজিক এক্সপেরিমেন্টাল শো’য়ের মঞ্চায়নে সঞ্চালনা করেন নাজিম উদ্দিন ।

অনুষ্ঠানটির শিল্প-পরিকল্পনায় রয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী এবং সার্বিক তত্বাবধানে সত্যব্রত দাশ স্বপন। অভিনব এই অনুষ্ঠানটি দর্শক নন্দিত হয় এবং অনুষ্ঠান শেষে শিল্পী মৌনী মুক্তা চক্রবর্তী তাৎক্ষণিক আঁকা চিত্রকর্মটি বিক্রি করে উত্তোলিত অর্থ টাওয়ার হ্যামলেটের একটি চ্যারিটিকে দান করার জন্য ছবিটি সিজন অফ বাংলা ড্রামা আয়োজন কমিটির প্রধান কাজী রুখসানা বেগমের কাছে হস্তান্তর করেন।

উল্লেখ্য লন্ডন বারা অফ টাওয়ার হ্যামলেট কতৃক আয়োজিত মাস ব্যাপী নাট্য উৎসব এ সিজন অফ বাংলা ড্রামার অংশ হিসাবে গত পহেলা নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই চিত্র প্রদর্শনী সমাপ্ত হবে আগামী ২৪শে নভেম্বর।

 

বিডি-প্রতিদিন/ সিফাত আব্দুল্লাহ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর