১৯৭২ সালে আমরা যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পড়ি, তখন বিভাগের শিক্ষকদের মুখে শুনেছি, এ অঞ্চলের প্রাচীন জনপদ এবং রানী ময়নামতীর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের কবি কাহ্নপাকে নিয়ে লোকশ্রুতি আছে। আর এই লোকগল্পকে আরও বেশি পোক্ত করেছে, ১৯৮৮ সালে সমতল ভূমি থেকে তিন মিটার গভীরে প্রাপ্ত একটি সুড়ঙ্গ পথের সামনে খননের মাধ্যমে রানী ময়নামতীর প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
জনশ্রুতি, চর্যাপদের কবি কাহ্নপার সঙ্গে রানী ময়নামতীর প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। সভাকবি কাহ্নপা ওই সুড়ঙ্গপথে রানী ময়নামতীর সাক্ষাতে যেতেন। ঐতিহাসিকের মতে, দশম শতাব্দীতে চন্দ্র বংশীয় রাজা মানিক চন্দ্রের স্ত্রী ময়নামতীর আরাম-আয়েশের জন্য এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১০ একর জায়গাজুড়ে লালমাই-ময়নামতী পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সমতল থেকে ১৫.২৪ মিটার উচ্চতায় একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় এই স্থাপনা অষ্টম থেকে ১২০০ শতকের প্রাচীন কীর্তি।
নাথ সাহিত্যের একাধিক কবির নাম অনুমান করা হয় যাদের জন্ম কুমিল্লায়। ১৫০০ বছর আগে প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহাস্থবির শীলভদ্রের জন্ম কুমিল্লার পার্শ্ববর্তী কৈলাইন গ্রামের ভদ্ররাজ পরিবারে। জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই অঞ্চলের পণ্ডিতদের শক্তিশালী ভূমিকার স্মৃতিচিহ্ন কোটবাড়ি-ময়নামতী শালবন বিহারে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো কালান্তরে সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে। অনুমিত হয়, প্রাচীন জনপদ সমতট থেকে অতীতের ত্রিপুরা হয়ে বর্তমান কুমিল্লা জেলার সভ্যতা, শিক্ষা, সাহিত্য সাংস্কৃতিক জীবন-স্পন্দনের শেকড় মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত।
এ রচনায় ইতিহাস থেকে স্বল্প পরিসরে তুলে আনা হয়েছে মণি-মুক্তার মতো অতীতের একগোছা দানা। আধুনিক যুগের বিশ-শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গনের যে ইতিহাস আমাদের গোচরে এসেছে, তাতে যে সমস্ত গুণী লেখক, সাধক, কীর্তিমান সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন শাখায় তাঁদের অবদান রেখেছেন তাঁরা সংখ্যায় অপ্রতুল নন। তাঁদের পথ ধরেই আমাদের বর্তমান। স্মর্তব্য, অধুনা কুমিল্লা জেলা পূর্বের বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা থেকে আয়তনে কমে এসেছে। ভূমি হিসেবে কুমিল্লা জেলা এখনকার মানচিত্রে সদর উত্তর এবং দক্ষিণ ঘিরে আছে দাউদকান্দি, হোমনা, চান্দিনা, মুরাদনগর, দেবিদ্বার, বুড়িচং, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম উপজেলা। তাই বর্তমান পরিধিতে যে সমস্ত লেখক, কবি, সাহিত্যিক কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন কেবল তাঁদের পরিচিতিই এ রচনায় স্থান পেয়েছে।
বাস্তবিক, শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, মন-মানসে, আধুনিক চিন্তা-চেতনায় কুমিল্লা জেলা প্রাচীনকাল থেকেই একটি অগ্রসরমান আলোকিত জনপদ। ময়নামতী শালবন লালমাটির রক্তিম-মায়া বুকে ধারণ করে এখানে জন্ম নিয়েছেন বহু কবি, লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতজন। তাঁদের সবার কীর্তি ও অবদান আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মননের সম্পদ। চর্যাপদের কাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় শাখা কাব্য। যাঁরা কাব্য রচনা করেছেন তাঁদের অনেকেই সাহিত্য-শিল্পের কেবল একটি শাখাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বৈচিত্র্যমণ্ডিত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁদের অবদান আমাদের সম্পদ। প্রয়োজনের তাগিদে বাংলাদেশের যেখানেই বাস করুন না কেন, তাঁরা এ জেলার মাটি ও মানুষ, প্রকৃতি-প্রেমকে তাঁদের অন্তরে ধারণ করেছেন। সাহিত্যের উপজীব্য করেছেন। কুমিল্লা জেলার গৌরবের ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে তাঁরা আলোকিত মানুষ। তাঁদের রচিত সমৃদ্ধ রচনাবলি আমাদের সাহিত্য-শিল্পের অঙ্গনে আনন্দযাত্রার গর্বিত ইতিহাস। ব্যক্তির শিল্পমানসে ধারণ করে ঋদ্ধ হওয়ার মতো প্রিয় বিষয়।
হে অতীত কথা কও
অতীতের কুমিল্লায় স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্বাগ্রে যে নামটি আমাদের বিমোহিত করে, প্রাণিত করে, অন্তরকে উদ্দীপ্ত করে তিনি নিজে বিদুষী নারী, শিক্ষানুরাগী, কবি এবং শাসক। মননে মা মাটি ও মানুষ যার চালিকাশক্তি। প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন মানবিক স্বভাবের উজ্জ্বল উদাহরণ। ‘রূপজালাল’ গ্রন্থের কবি নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩)। যাঁর সাহিত্যকীর্তি আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে গৌরব এবং সমৃদ্ধি দান করেছে। নগর-সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র কুমিল্লা নগর মিলনায়তনের রূপকার ও স্থপতি ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের (১৮৩৭-১৮৯৬) নামসহ যে সমস্ত ব্যক্তিত্বের কর্ম, চিন্তা ও মানবিক গুণের ওপর ভিত্তি করে কুমিল্লার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি পোক্ত হয়েছে তাঁরা আমাদের চিরকালের প্রাতঃস্মরণীয়। বিদ্যান হর দয়াল নাগ, সমাজসেবক মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সংস্কৃতজন নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, শিক্ষানুরাগী রায়বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায়, সৈয়দ আবদুল জব্বার, নওয়াব সৈয়দ হোচ্ছাম হায়দার চৌধুরী, অখিল চন্দ্র দত্ত, খান বাহাদুর আবিদুর রেজা চৌধুরী, আবদুর রসুল, খান বাহাদুর আবদুল করিম, নওয়াব মোশারফ হোসেন, বসন্তকুমার মজুমদার, নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, কামিনী কুমার দত্ত, সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মণ, ভাষা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, হেম প্রভা মজুমদার, নওয়াব স্যার কে জি এম ফারুকী, আশরাফউদ্দীন আহমদ চৌধুরী, অতীন্দ্র মোহন রায়, রাসমোহন চক্রবর্তী, শহীদুল হক, খান বাহাদুর মফিজউদ্দীন আহমদ, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর আবদুল গণি যাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগ কুমিল্লার ঐতিহ্য ও ইতিহাস নির্মাণে অক্ষয় ভূমিকা রেখে গেছে।
অতীতের এমন সমৃদ্ধ ধারাবাহিক গুণীজনের সংস্পর্শে কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গনও ছিল বহমান সময়ের ঋদ্ধ প্রতিলিপি। এ শিল্পের বিভিন্ন শাখায় সমকালের লেখকদের দক্ষতায় গুণে-মানে ও বৈভবে এ অঞ্চলের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ আলোকিত হয়েছে। শত বছর ধরে তাঁদের সৃষ্টিশীল রচনা আমাদের সাহিত্যের গৌরবের পথকে মসৃণ করেছে। তাঁরা আমাদের অগ্রজ, প্রাতঃস্মরণীয়, নিত্য-বরণীয়। এসব মহীয়ান মানুষের চলার পথের চিহ্ন ধরে এগিয়ে এসেছে আমাদের বর্তমান। বিশ শতকের বিশের দশক থেকে সত্তর দশক পেরিয়ে বর্তমান পর্যন্ত এঁদের রচনার মায়াজাল কুমিল্লার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে বেগবান করেছে। মানসম্পন্ন করেছে। ১৯৪৭-এর পরে পাকিস্তানের এ অংশের মানুষের আশাআকাক্সক্ষা, বঞ্চনা-যন্ত্রণার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে সমকালের লেখকরা একটি স্বাধীন জাতির মন ও মানসকে গড়ে তুলেছেন। ভাষা আন্দোলনের উত্তরাধিকার হিসেবে রক্তের দায় বহন করে ঊনসত্তর, একাত্তরের জন্ম দিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী মানুষকে আত্মত্যাগে উজ্জীবিত করে গেছেন। সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের ইতিহাসের মেদ-মজ্জা পুষ্টি দান করেছেন।
স্মর্তব্য, সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি গবেষণার কাজও হয়েছে সমানতালে। যাতে উঠে এসেছে অতীত থেকে বর্তমানে চলার পথের, এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা, সাংস্কৃতিক পরিচয়। পেশাজীবনে যাঁরা এই সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের অনেকেই স্থানীয় কলেজে স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন, ছিলেন রাজনীতিক এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। নিজ নিজ পেশার ফাঁকে সাহিত্যচর্চা, গবেষণা ছিল তাঁদের প্রাণের বিষয়। কালনিরপেক্ষ কুমিল্লার মানবিক-মানসিক সমৃদ্ধির রূপকার তাঁরা। তাঁদের সাধনা প্রতিদিন আমাদের প্রাণের আহার জোগায়। প্রবীণ এবং নবীনের মেলবন্ধন থেকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছি অগ্রজ লেখক, গবেষকের নাম। একই সঙ্গে তাঁদের পরের প্রজন্মকেও।
তাঁরা হলেন- সিরাজউদ্দীন হায়দার, হাফিজ কারি সগীর মোহাম্মদ, আলী আকবর খান, সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত, নার্গিস আসার খানম, তোরাব আলী, এ কে এম মোশারফ হোসেন, এম এ আযম, সুধা সেন, সাজেদুল করিম, এ কে এম নাজমুল করিম, কাজী শামসুল ইসলাম, আহমদ ফজলুর রহমান, সুলতান মাহমুদ মজুমদার, রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী, মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস, অজিত কুমার গুহ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অজয় ভট্টাচার্য, আসহাব উদ্দিন আহমদ, অমিয় কুমার সেন, আ কা ম জাকারিয়া, সুলতান আহমদ ভূইয়া, মোবাশ্বের আলী, কাজী নুরুল ইসলাম, বদরুল হাসান, লায়লা নূর, সুধীন দাশ, সুরেন দাশ, আবু জায়েদ শিকদার, অ্যাডভোকেট আহমদ আলী, আতাউর রহমান খান খাদিম, এ জেড এম শামসুল আলম, এ কে এম নাজির আহমদ, আবদুল গনি, আমিনুল ইসলাম, আলী নেওয়াজ (ড.), আলী আহমদ, আলী ইমাম, মোহাম্মদ আবু নসর শহীদুল্লাহ, খোন্দকার রিয়াজ-উদ্-দীন আহমদ, সিদ্দিকুর রহমান, মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন (ড.), তিতাশ চৌধুরী, আবদুল ওহাব, মোনায়েম সরকার, শান্তিরঞ্জন ভৌমিক, আবদুল জলিল, সাঈদ-উর-রহমান (ড.), খালেদা এদিব চৌধুরী, পান্না কায়সার, মোস্তফা কামাল, সাজেদুল করিম, বেলাল চৌধুরী, জাহিদুল হক, স্বপ্না রায় (ড.), অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক। এঁদের পরে সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি নানা বিষয়ে গবেষণার কাজে জড়িয়ে আছেন অনেকেই, তাঁরা হলেন- আনোয়ারুল হক (ড.), আলী হোসেন চৌধুরী (ড.), আবুল কাসেম (ড.), মোসলেহ উদ্দীন (ডা.), আবুল আজাদ (ড.), প্রবীর বিকাশ সরকার, মঞ্জুরুল আজিম পলাশ, ইসহাক সিদ্দিকী, জাভেদ হুসেন, মোহাম্মদ আবুল কাসেম (হৃদয়) প্রমুখ।
উপর্যুক্ত অনেকেই বহুমাত্রিক লেখক। সাহিত্য শিল্পের অন্যান্য শাখায়ও আমরা পেয়েছি তাঁদের অনায়াস পরিভ্রমণ। এ প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য নয়, কুমিল্লায় সেই সময়, নিজের লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্য পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। হয়েছে পঞ্চাশের দশকে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মেলন। ষাট দশকে প্রকাশিত হয়েছে কিছু কিছু পত্রিকা। যেমন, ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘পূর্বাশা’। দেশের প্রাচীন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ফজলে রাব্বীর ‘আমোদ’, যা’তে স্বল্প হলেও সমকালের লেখকরা শ্বাস ফেলার জায়গা পেতেন। শামছুন্নাহার রাব্বী সম্পাদিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘ময়নামতী’। পরবর্তীকালে সম্পাদক আবদুল ওহাবের ‘রূপসী বাংলা’। এখানেও এক পাতার জায়গা ছিল লেখকদের। জন্ম হয়েছে সাতজন উদ্যোগী যুবকের সাহিত্য সংগঠন ‘সপ্তর্ষি’।
বর্তমানে শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ‘অরুণিকা’ আর মোতাহার হোসেন মাহবুবের ‘আপন’ এ দুটি সাহিত্য পত্রিকা অনিয়মিত চালু আছে।
আর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত ম্যাগাজিন, ক্ষুদ্র আকারের পুস্তিকা ছিল সমকালের লেখক, কবি সাহিত্যিকদের মনোদর্পণ।
সত্তর দশকের শেষ প্রান্ত থেকে এ পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। রাজনীতিতে জাতীয় জাগরণ নতুন রূপ ধারণ করে। উত্তাল হয়ে ওঠে এ সময়। রাষ্ট্র ও সমাজ বদলের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে পুরো দেশ মুখর হয়ে ওঠে। কুমিল্লাতেও সেই সময় আমাদের বয়সি যৌবনের রক্তে লাগে আগুনের তাপ। দিকে দিকে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে যুব-সংগঠন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ‘ইদানীং আমরা’, ‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী’র মতো আধুনিক কবিতার জমিন সৃষ্টি হয় তখন। সমকালের লেখকদের মনোভূমিতে জমা হওয়া নতুন সময়ের পলিমাটির রং লাগে কবিতায়, গল্পে, চিন্তায়।
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে...
এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের তরল অনলে পোড়া। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নভরা তাজা তখন এক একটি তারুণ্য, যৌবন। সারা দেশের মতো কুমিল্লার সাহিত্য শিল্পাঙ্গনে নতুন কিছু করার উদ্যম চারদিকে। সাহিত্যাঙ্গনে শক্তিশালী ভূমিকায় এরা ছিল উদয়াস্ত তৎপর। প্রত্যেকের অন্তরে টগবগ করে ফুটছে দিনবদলের শব্দের প্রবাহ। জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লিখেছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, মুক্তনাটক। ছাপা হচ্ছে সময়োচিত প্রতিবাদী রচনা। উদ্দীপনার এ সৃষ্টিযজ্ঞে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গনে জীবন ও যৌবনের রাজপথ বদলের অঙ্গীকার। মনের তাগিদে কেউ কেউ গড়ে তোলে সাহিত্য সংগঠন।
আলী হোসেন চৌধুরী ও সৈয়দ আহমেদ তারেকের যৌথ উদ্যোগে জন্ম নেয় ‘ইদানীং আমরা’। প্রকাশ করে লিটল ম্যাগাজিন ‘উপদ্রুত পলাশ’। প্রতিষ্ঠিত হয় জহিরুল হক দুলাল এবং শওকত আহসান ফারুকের উদ্যোগে সাহিত্য সংগঠন ‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী’। ফখরুল হুদা হেলাল এবং ফখরুল ইসলাম রচির মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় ‘সে আমি তুমি’। তিতাশ চৌধুরীর ‘অলক্ত সাহিত্য পরিষদ’, রমিজ খানের ‘উষসী’, বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের ‘উদীচী’। অকাল প্রয়াত ফজল মাহমুদের সম্পাদনায় সাহিত্য পত্রিকা ‘চিরকুট’। এ ছাড়া বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হতে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবসে, বৈশাখে, ফাল্গুনে বের হয়েছে কবিতা, গল্প, ছড়ার অসংখ্য ‘ছোট কাগজ’। কবিতা, ছড়া, গল্পের কাগজ, মঞ্চে নতুন দিনের নাটক। লেখা প্রকাশের বাহন হয়েছে সময়ের কণ্ঠে মুক্তো দানার মতো এসব ছোট কাগজ, পুস্তিকা ও ডাবল ডিমাই সাইজের এক পাতার সাহিত্য পাতা। তাদের নামও হতো কবিতার মতো, যেন সোনার হাতে সোনার কাঁকন। অশ্রু হলো বারুদ, চাবি খুঁজছি মহারাজ, পউষ এল যুবরাজ, রাধা, বেশ কিছুদিন শান্ত ছিলাম, কবিতা আমার ঈশ্বর, নদী নিরবধি, কবিতা আমার সুখ, ছিপ ফেলে বসে আছি, কবিতার তৃপ্ত ঝুমঝুমি, সুবর্ণ গ্রামে যাবো। গল্প সংকলন : চোখ, সাবধানী নাবিক। ছড়া সংকলন : তা তা থৈ থৈ। শুধু কুমিল্লা নয়, সাহিত্যাঙ্গনের বড় আসরেও এই সময়ের লেখকদের কবিতা, গল্পে সমৃদ্ধ লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাশাপাশি সাহিত্য সংগঠনগুলো ওই সময়ে কুমিল্লার সাহিত্যিকদের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। উল্লেখ্য, ’৭৩-এর শেষদিকে সাহিত্য সংগঠন ‘সে আমি তুমি’র উদ্যোগে ফখরুল হুদা হেলাল এবং ফখরুল ইসলাম রচির সাংগঠনিক সাহসী উদ্যোগে কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশে প্রথম দুই দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন। বাংলাদেশের প্রথম সারির কবি, সাহিত্যিকরা এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক ‘এ সভা প্রস্তাব করছে’, ‘উদাহরণ’, ‘দীপাধার’, ‘নাচ ময়ূরী নাচ’-এর মতো কবিতাপত্র।
কবিতা ছাড়াও লেখক হিসেবে যাঁরা এই সময়ে সক্রিয় থেকেছেন তাঁরা বলা ভালো, বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের আগের হাল। স্মরণ করি, সুভাষ পাল, সারোয়ার জাহান, জহিরুল হক দুলাল, ফখরুল আবেদীন দুলাল, শামসুজ্জামান হীরা, বিমানকান্তি সাহা, মানবেন্দ্র সাহা, শওকত আহসান ফারুক, আলী হোসেন চৌধুরী, আনোয়ারুল হক, সৈয়দ আহমাদ তারেক, আইনুল হক মুন্না, সুহাস রায়, অরুণ চৌধুরী, মোস্তফা হোসেইন, নীরু শামিম ইসলাম, মোহসেনা চিনু, আবু মোহাম্মদ হাবীবউল্লাহ, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ফখরুল হুদা হেলাল, মোস্তফা হোসেইন, নুরুন্নাহার শিরিন, নাজনীন রহমান নাজমা, কামাল চৌধুরী, ফরিদ মুজহার, হাসান ফিরোজ, আলাউদ্দীন তালুকদার, ফখরুল ইসলাম রচি, বাবুল ইসলাম, মঞ্জুর-ই করিম পিয়াস, ফজল মাহমুদ, তৃপ্তি চক্রবর্তী, খায়রুল আহসান মানিক। ইসহাক সিদ্দিকী, মনসুর হেলাল, বেগম ফাতেমা আলী, হুমায়ুন কবীর, পরিমল কান্তি পাল, ইকবাল আনোয়ার, এস এম ইলিয়াস, জিল্লুর রহমান জনসহ আরও অনেকে, যাদের কেউ কেউ বহুমাত্রিক লেখক।
উল্লেখ করতেই হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কুমিল্লায় গড়ে ওঠে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। ঢাকাসহ সারা দেশে এই আন্দোলনের প্রভাব সমকালে তারুণ্যের মনে গাঙের ঢেউয়ের মতো দু’কূলপ্লাবী ছিল। যার ফলে কালের চাহিদায় নাট্যকার, নাট্যশিল্পী ও নাট্যসংগঠক সৃষ্টি হয়। গড়ে ওঠে ‘যাত্রিক’, ‘জনান্তিক নাট্য সম্প্রদায়’, ‘অভিনয়’, ‘সংলাপ’সহ অসংখ্য নাট্যসংগঠন। মঞ্চের প্রয়োজনে পুরোনো প্রথা ভেঙে মঞ্চের জন্য তখন রচিত হয়েছে মৌলিক নাটক। এই তালিকায় আছে মোহাম্মদ কাসেম, কে এম নিজাম, শান্তিরঞ্জন ভৌমিক, আনোয়ারুল হক, অরুণ চৌধুরী, হাসান ফিরোজ, জাফর আহমদ চৌধুরী, শরীফ আহমেদ অলী, শাহজাহান চৌধুরী, আহমেদ কবীর প্রমুখের নাম।
ওরা নবীন ওরা বৈচিত্র্যের
এই প্রজন্মের পরে কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গনে কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাসে যারা জাতীয়ভাবে লেখালেখিতে এখনো নিয়োজিত রয়েছেন তাঁরা নিজেদের অঙ্গনে গৌরবের আসনে আসীন। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তাঁদের কবিতায় বৈচিত্র্য, জীবনবোধ, উপস্থাপনা, দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। পাঠকের রুচিতে তারা এনেছেন ভিন্নতার স্বাদ। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আছে তাঁদের দৃপ্ত পদচারণ। এরা হলেন- শাহীন আখতার, বায়তুল্লাহ কাদেরী, আবুল আজাদ, জাকির আজাদ বাবু, জাকির হোসেন কামাল, মাহমুদ কচি, উত্তম গুহ, আহমেদ কবীর, মাসুক হেলাল, খালেদ চৌধুরী, শাহ আহমদ শরীফ শুভ, আরিফুল হাসান, শামীম হায়দার, বিজন দাস, রতন ভৌমিক প্রণয়, হালিম আবদুল্লাহ, খলিলুর রহমান শুভ্র, রুবেল কুদ্দুস, মতিন রায়হান, মনসুর হেলাল, জয়শিস বণিক, চৌধুরী আতাউর রহমান রানা, নার্গিস আক্তার, শিরিন হোসেন, মোহাম্মদ শাহজাহান, ঋতু অনিকেত, মোতাহার হোসেন মাহবুব, তৃপ্তিশ ঘোষ, মল্লিকা বিশ্বাস, সৈয়দ আবদুল ওয়াজেদ, মুহম্মদ মাহবুব আলী, সেলিনা শিরিন শিকদার, জে এন লিলি, হুমায়ুন কবীর জীবন, কুলসুম আক্তার সুমী, সৈয়দা ফেরদৌস সুলতানা, মিজানুর রহমান, কিরণ আহমেদ, কল্লোল মজুমদার, বাকীন রাব্বী ও আবুল বাসার।
পরের দশক থেকে আরও পরে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক পট পরিবর্তন হয়েছে। যুগ-বদল হয়েছে। একুশ শতকের পরিবর্তিত সময়ে কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গনে এসেছে নতুন নতুন মুখ। প্রতিভা। কবিতা ছাড়াও কথাসাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা গল্পে, উপন্যাস, নাটকের ভুবনে তারা রেখেছেন সৃজনশীল ভাবনার স্বাক্ষর। সময়ের অভিঘাতে, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবেশ সবকিছু থেকে প্রত্যাশার বিপরীতে অপ্রাপ্তি বঞ্চনা ইত্যাদির কারণে এই সময়ের লেখকদের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনবোধ অগ্রজ লেখকদের থেকে আলাদা। প্রচলিত ধারণার বাইরে এসব তরুণ লেকক নিজেদের জগৎ নির্মাণ করেন। তাদের আবেগ তীব্র চিৎকার। সমাজের অসংগতি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের লেখায় খোলামেলা, জীবন-ঘেঁষা আর্তনাদ। এর প্রকাশের ভাষাও তাদেরই তৈরি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস সাহিত্য শিল্পের সব শাখাই তাদের লেখার ক্ষেত্র। পিয়াস মজিদ, ইশরাত তানিয়া, মামুন সিদ্দিকী, কাজী মোহাম্মদ আলমগীর, শাহাজাদা এমরান, আরিফুল হাসান, সৌম্য সালেক, হাসান রেজা সাঈদ, মাসুদা তোফা, তাসরিনা শিখা, ইয়াসমীন রীমা, মেহেরুন্নেসা, রোকসানা ইয়াসমীন মণি, মাসুদ রানা চৌধুরী, আহসানুল কবীর, মো. আবু তাহের, মো. এমদাদুল হক, এস এম ইলিয়াস, নূরুল ইসলাম মনজুর, আবু খলদুন আল মাহমুদ, উত্তম বহ্নি সেন, শাহীন শাহ, দীপ্র আজাদ কাজল, কমল মজুমদার, ইমন আহমেদ, হৃদয় রেজওয়ান, নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী, অমিত ভট্ট, নাসরিন তামান্না, শামীম হায়দার, মো. আসাদুজ্জামান, আহমেদ মুসলেহ, জলিল সরকার, নূরজাহান আক্তার, নূরুল আলম সেলিম মিয়াজী, ইলিয়াস শাহ, ভুইয়া তাজুল ইমলাম, জোবাইদা নূর খান, জাফরিন সুলতানা, নিজাম উদ্দিন রাব্বী, সুলতানা দিপালী, দিলীপ পোদ্দারসহ এই তালিকায় আছে আরও অনেকে।
কুমিল্লার জনজীবন জনপদ মেঘনা গোমতী তিতাসের জলে বিধৌত পলিমাটির মায়ায় প্রাচীনকাল থেকে সিক্ত। এখানকার বাতাসে নদী-জলের ঢেউয়ে উঠে আসে গীতল সুর। কী মাঝি, কী শ্রমজীবী মানুষ, কী বাউল ফকির সবাই সেই সুরে মজে, হেলেদুলে, তাঁর বাঁধে। উদাত্ত কণ্ঠে গান গায়। এই মাটি ওস্তাদ আয়াত আলী খান, মনোমোহন, শচীন কর্তাসহ অসংখ্য সেতারের সুরে বাঁধা গীতিকারের। দেশবরেণ্য প্রখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, অজয় ভট্টাচার্য, মীরা দেব বর্মণ, এস এম হেদায়েত, কুলেন্দু দাস, ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া, রংগু শাহাবুদীন, সফিকুল ইসলাম ঝিনুক, সমর মোদক, মৃণালকান্তি ঢালী বহন করছেন তাঁদেরই উত্তরাধিকার।
সবশেষে, বিশ্বাসে আনত হই, আমাদের অগ্রজরা যাঁরা কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেছেন, কিংবা শুয়ে আছেন সেটা আসলেই বড় কথা নয়। বড় কথা হলো- মাটির কোথায়, কোন গভীরে তিনি সবুজ হয়ে জেগে আছেন। আমরা জানি, সাহিত্য সাধনার পথ কঠিন। এই পথের মিছিলে সবাই জেগে থাকে না। কালান্তরে রসপিপাসু মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা সবার থাকে না। কেউ কেউ জাগে। আমাদের হৃদয়ে তাঁদের সৃষ্টিতে বেঁচে থাকেন। চিরকালের সারস্বত সমাজের আলোকবর্তিকা তাঁরা। কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গন থেকে নক্ষত্রের আলোরা, যাঁরা জেগে আছেন প্রত্যাশা করি, নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে কাল থেকে কালান্তরে তাঁরাই আমাদের ধ্রুবতারা।