রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ইকবাল মতিনের সংগ্রহে আছে প্রায় আট হাজার গ্রামোফোন রেকর্ড। এর মধ্যে গান তো আছেই, ভাষণ, নাটকও আছে। উদয় শংকর বিশ্বাস তার সংগ্রহশালা দেখে অবাক হয়েছেন। ইকবাল মতিন জানালেন, উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গান শোনার জন্য কলের গান ছাড়া উপায় ছিল না। ১৯০২ সালে প্রথম ৭৮ আরপিএম (প্রতি মিনিটে ৭৮ ঘূর্ণন, পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত চালু ছিল বেশি) রেকর্ড প্রচলনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে কলের গানের যাত্রা শুরু হয়। আর তার চল ছিল আশির দশক পর্যন্ত। নওগাঁর কাশিমপুরের জমিদার ছিলেন শরৎকুমার মৈত্র। ইকবাল মতিন তার সাহচর্য পেয়েছিলেন। তারই উৎসাহে কলের গান সংগ্রহ শুরু করেছিলেন ইকবাল মতিন। তখন তার বয়স ১৩ বছর। তিরিশের দশক পর্যন্ত প্রকাশিত রেকর্ড সংগ্রহ করতেই বেশি পছন্দ করেন। চল্লিশের দশকেরও আছে কিছু। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এমন রেকর্ড তা যে সময়েরই হোক সংগ্রহে রাখতে চান ইকবাল মতিন। রাজশাহী মহানগরীর সাগরপাড়ায় থাকেন তিনি। একটি পুরো ঘর তার রেকর্ডঘর। ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইকবাল মতিন। কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। এইচএসসি পাসের পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রাজশাহীতে ভর্তি হন। এখন এটি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। ১৯৭৯ সালে তিনি পুরকৌশলে বিএসসি প্রকৌশলী হন। ওই বছরই প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানিসম্পদ কৌশল বিষয়ে স্নাতকোত্তর হন। তিনি একজন জনপ্রিয় বেহালা বাদকও। প্রখ্যাত বেহালাবাদক প-িত রঘুনাথ দাসের শিষ্য তিনি। ইকবাল মতিনের পৈতৃক বাসার আটটি কক্ষে মাত্র তিনজন মানুষ থাকেন। বেশির ভাগ কক্ষ গানের রেকর্ড আর বইপুস্তকের দখলে। পৃথিবীর যেখানে যখন গেছেন, দুর্লভ বই পেলেই কিনেছেন। একটি বইয়ের পেছনে তার ২৪ হাজার টাকা ব্যয় করারও রেকর্ড আছে। ঘরে ঘরে থরে থরে সেই বই সাজিয়ে রেখেছেন। একইভাবে রেখেছেন গানের রেকর্ডও।
সংগ্রহে বিভিন্ন আকারের রেকর্ড :
বেশি প্রচলিত ১০ ইঞ্চি রেকর্ড তো আছেই; তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট ও ৯ ইঞ্চি মাপের রেকর্ডও সংগ্রহে রেখেছেন ইকবাল মতিন। দুষ্প্রাপ্য ১১, ১২ আর ১৬ ইঞ্চি মাপের রেকর্ডও আছে তার সংগ্রহে। আছে লালচাঁদ বড়াল, জাদুমণি বাইজি, মিস ফুলকুমারী, গোবিন্দ গোস্বামীর রেকর্ড। নিকোল কোম্পানির পিচবোর্ড রেকর্ড যেমন আছে, ভোগ কোম্পানির প্লাস্টিক রেকর্ডও আছে। ভোগ কোম্পানির রেকর্ডগুলোকে পিকচার রেকর্ড বলা হতো। কারণ বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে সেগুলোর ওপর ছবি থাকত।
দুর্লভ সংগ্রহশালা :
লালচাঁদ বড়ালের খেয়ালের কথাই ধরা যাক। ১৯০২ সালের রেকর্ড। শশীমুখী ও ফণীবালার বাংলা গানও ওই বছরই ধারণ করা। তারপর ওস্তাদ এমদাদ খাঁর সেতার বাদনের রেকর্ড। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত। ইকবাল মতিনের সংগ্রহে আছে এগুলো। তারপর ওস্তাদ তালিম হুসেনের সানাই এবং বীণকার ওস্তাদ আবদুল আজিজ খাঁর রেকর্ডের প্রথম কপিও আছে ইকবাল মতিনের সংগ্রহে। কিরানা ঘরানার ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ সাহেবের বীণা বাদনের রেকর্ডও আছে ইকবাল মতিনের কাছে। জার্মানির ওডেওন (Odeon) কোম্পানি বের করেছিল রেকর্ডটি। করিম খাঁ সাহেবের স্ত্রী সরস্বতী বাই মিরাজকারের রেকর্ডটিও আছে ইকবাল মতিনের সংগ্রহে।
গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি প্রথম বাজারে আনে গহরজানের রেকর্ড ১৯০৩ সালে। শশীমুখী ও ফণীবালার কণ্ঠ ধারণ করা হয়েছে আগে, কিন্তু বাজারে এসেছে গহরজানের পরে। মিস গহরজান নামে পরিচিত এই শিল্পীর ২৮টি রেকর্ড আছে ইকবাল মতিনের সংগ্রহে। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার অমলা দাস, কুমারী সরোজ, বেদানা দাসী, সত্যবালা দেবী, মিস বরদাসুন্দরী, রমা বাই, বিনোদিনী দাসী, মানদাসুন্দরী দাসী, যমুনা দাসী, নীহারবালা, কোহিনূরবালা, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, চারুবালা, রেণুবালা, বিন্দুবালা, কাননবালা, ফিরোজা বেগম প্রমুখ নারী কণ্ঠশিল্পীর হাজারের বেশি রেকর্ড আছে তার সংগ্রহে। আর পুরুষ কণ্ঠশিল্পীদের তালিকায় আছেন বিজয় গোপাল লাহিড়ী, হেমচন্দ্র সেন, নিকুঞ্জ বিহারী দত্ত, পান্নালাল সরকার, লালচাঁদ বড়াল, নারায়ণচন্দ্র মুখার্জি, দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী, অঘোরনাথ চক্রবর্তী, তিনকড়ি চক্রবর্তী, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, বলাই দাস শীল, রামকৃষ্ণ লাহিড়ী, ধীরেন দাস, চিত্তরঞ্জন গোস্বামী, কে মল্লিক, পাহাড়ী স্যানাল, ভবানীচন্দ্র দাস, কে এল সায়গল, রাধাগোবিন্দ গোস্বামী, এ এন মল্লিক, জে এন দাস, এ গফুর, পুলিন বিহারী, নলিনীকান্ত সরকার, আবদুল লতিফ প্রমুখ। যন্ত্রসংগীতের সংগ্রহ : ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ উজির খাঁ, ওস্তাদ চুন্নু খাঁ, ওস্তাদ দবীর খাঁ, ওস্তাদ আমির খাঁ, ওস্তাদ হুসেন খাঁ প্রমুখ সরোদ শিল্পীর রেকর্ড আছে ইকবাল মতিনের কাছে। সানাইশিল্পী আলী বিসমিল্লাহ খাঁর গুরু আলী বখশের রেকর্ডও আছে। সেতার বাদকদের তালিকায় আছেন ওস্তাদ এনায়েত খাঁ, ওস্তাদ বরকতুল্লাহ খাঁ প্রমুখ। হারমোনিয়াম, তবলা, বীণা, সারেঙ্গী, বেহালা, সানাই, বাঁশি, এসরাজ, জলতরঙ্গ, সুর শৃঙ্গার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের প্রায় সব শিল্পীর রেকর্ড আছে। বিশ শতকের শুরুতেই কলকাতায় গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি থিয়েটার। যেমন স্টার থিয়েটার, ন্যাশনাল থিয়েটার, ক্লাসিক থিয়েটার, মিনার্ভা থিয়েটার ইত্যাদি। তখন হরিশ্চন্দ্র, চন্দ্রগুপ্ত, আলিবাবা, সীতার বনবাস, অন্নদামঙ্গল, সাবিত্রী, নিমাই সন্ন্যাস, বিদ্যাপতি, মীরাবাই, বেহুলা, দাতা কর্ণ, দক্ষযজ্ঞ, রামের বিবাহ, ভক্ত হরিদাস, জয়দেব ইত্যাদি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পালাগুলো খুব জনপ্রিয় ছিল। এমন ৬৪টি রেকর্ড আছে ইকবাল মতিনের কাছে। অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফী, তিনকড়ি চক্রবর্তী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ ধরে রেখেছেন ইকবাল মতিন। তার কাছে তারাসুন্দরী, কোহিনূরবালা, কঙ্কাবতী, সুশীলা দাসী, প্রকাশমণি প্রমুখ অভিনেত্রীর গান ও নাটকের অংশবিশেষের রেকর্ডও আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বকণ্ঠে ধারণ করা আটটি গান, ১০টি কবিতা ও গীতাঞ্জলির দুটি ইংরেজি কবিতার রেকর্ড আছে ইকবাল মতিনের কাছে। মহাত্মা গান্ধীর বক্তৃতার এক দুর্লভ রেকর্ড আছে ইকবাল মতিনের সংগ্রহে। ১৯৩১ সালে ইংল্যান্ডের কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি এটি প্রকাশ করেছিল। ইকবাল মতিনের ব্যক্তিজীবনের গল্পও সংগ্রহে রাখার মতো। ৪৩ বছর ধরে একই সাইকেলে চেপে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। আগে ছিলেন ছাত্র। এখন শিক্ষক। আর্কিটেকচার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। কিছুদিন পর অবসরে যাবেন। তিনি বলেন, একজন আদর্শ শিক্ষকের ঐশ্বর্য বাইরের জিনিসে নয়।