তুষারপাত আর মেঘের হোইট-আউটের ভিতর থেকে একটা সময় গাইড তিনজনকে দেখতে পেলাম। তারা হাইক্যাম্প স্থাপন করে ফিরে আসছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তাদের ওপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে। মাল্লা জানালেন, ওপরে খাড়া ঢালে রোপ ফিক্সড করেছে এবং হাইক্যাম্প স্থাপন করেছে। তাদের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল বেশ বিপজ্জনক জায়গায় হাইক্যাম্প। ওপর থেকে পাথর পড়ার ভয় রয়েছে। হিডেন ও ওপেন ক্রেভার্সও আছে এবং প্রায় হাঁটু পর্যন্ত তুষারও জমেছে। আবহাওয়া তো এখন পুরোপুরিই খারাপ। তবে সিদ্ধান্ত হলো সকালে যদি আবহাওয়া ভালো হয় তাহলে হাইক্যাম্পের উদ্দেশ্যে বের হব আমরা। সন্ধ্যার দিকে ভয়ঙ্কর ঝড়ো বাতাস শুরু হয়ে গেল। তাঁবুতে মূল অভিযান নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছিল। মাল্লাও আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমরা তাড়াতাড়ি রাতের খাবার সেরে যার যার তাঁবুতে ঢুকে গেলাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। ঝড়ের তেজ যেন বেড়েই চলছে। এক পর্যায়ে মনে হলো ঝড়ো বাতাস তাঁবুসহ আমাদের উড়িয়ে নেবে। বুকটা কাঁপিয়ে তুলল পাশের পর্বতের গা থেকে ভেসে আসা অ্যাভেলাঞ্জের ভয়াবহ গর্জন। নানান দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ভর করল। শেষ পর্যন্ত মাঝরাতের দিকে থামল সেই ঝড়ের তাণ্ডব। তবুও ঘুম এলো না। সকাল হয়ে এলো। চমৎকার এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। যে স্বপ্নকে আঁকড়ে এই দুর্গম পর্বতে এসেছি সেই মূল অভিযান শুরু হচ্ছে আজ। অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াতে যাচ্ছি আমরা। জানি না ফেরা হবে কি না। তবু এক ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের দিকে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার বাসনা। সকালের নাস্তা সেরে আমরা পাঁচজন এবং তিনজন ক্লাইম্বিং গাইড বেরিয়ে পড়লাম হাইক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। মাল্লা ও নিমা শেরপা আগে চলে গেলেন। হাইক্যাম্পের উপরে একটি খাড়া দেয়াল আছে। সেখানে রোপ ফিক্স করতে এবং সামিটের রোড ওপেন করতে। আমাদের সঙ্গে আছে তাশি শেরপা। সবার আগে তাশি, তাকে অনুসরণ করে মুহিত ভাই, বিথী, আমি, নুর ভাই এবং বিপ্লব ভাই এগিয়ে চলছি। হঠাৎ পেছন থেকে বিপ্লব ভাই চিৎকার করে উঠলেন। নুর ভাই যে আলগা পাথরের বোল্ডারে পা রেখেছেন সেটা গড়িয়ে বিপ্লবের দিকে এসেছে। অল্পের জন্য তারা দুজনেই রক্ষা পেলেন। খুবই সাবধানে আমাদের পা রাখতে হচ্ছে পাথরের বোল্ডারের ওপরে। ঘণ্টাখানেক পর চলে এলাম ক্র্যাম্পন পয়েন্টে। এখানে এসে আমরা হার্নেস ও ক্র্যাম্পন পরে নিলাম। দেখতে দেখতে চারপাশ মেঘে ছেয়ে গেল। এখান থেকে আমার মেইন রোপে (দড়ি বেঁধে) আরোহণ শুরু করছি। এদিকে প্রচণ্ড তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেছে। তাপমাত্রা নেমে গেছে শূন্যেরও পনেরো ডিগ্রি নিচে। বরফের ভিতরে হাঁটু পর্যন্ত পা ঢুকে যাচ্ছে। খাড়া ঢাল হওয়াতে উপরে উঠতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। যতটুকু সামনে এগোই ঠিক ততটুকুই নিচের দিকে নেমে আসি। এদিকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েও থাকা যাচ্ছে না। বাতাসের গতিও আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তুষারপাতে চারপাশ হোয়াইট আউট হয়ে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি বিপ্লব ভাইকেও দেখা যাচ্ছে না। আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছি। কিছুটা সমতল জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। পাশেই পাথরের দেয়াল। সেই সকালে খেয়েছিলাম। এখন ক্ষুধায় শরীরটাও বেশ ক্লান্ত। গাইড আমাদের সতর্ক করে বলেন, আমরা যে পথ দিয়ে যাব সেই পথে অনেকগুলো ক্রেভার্স (ফাটল) আছে। তুষারপাতের কারণে হয়তো সেই ক্রেভার্সগুলো ঢেকেও গেছে। তাই পথটুকু ভীষণ বিপজ্জনক। যে পথে যাচ্ছি তা আবার তুষারধস এলাকা। হাইক্যাম্পে যাওয়ার শেষ চড়াইটা একটু বাঁক খাওয়ানো। বাঁকের এখানে বড় একটা বরফের ক্রেভার্স। এ পথে ফিক্সড রোপ লাগানো। এখানে পাথরের বোল্ডারও বেশি। তাই পথটাও ভয়ঙ্কর। ঘড়ির কাঁটা তখন বিকাল চারটে। এদিকে মাল্লা ও নিমাও ওপর থেকে নেমে এসেছে। গাইডরা এখানে ছোট একটি জায়গার মধ্যে বরফ সরিয়ে তিনটি তাঁবু লাগালেন। হাইক্যাম্পের তিন পাশেই উঁঁচু বরফ ও পাথরের দেয়াল। তাঁবুর কাছেই অনেক ক্রেভার্স। তাঁবুর মুখ থেকেই ক্রেভার্সেও ঢালু। ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে এই ক্যাম্প। আশপাশে এর থেকে ভালো জায়গাও নেই যে ক্যাম্প করবে। বাতাস কমলেও কমেনি তুষারপাত। আমরা তাঁবুর ভিতরে ঢুকে গেলাম। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। তাশি শেরপা গরম নুডলস মগে করে এলেন। সঙ্গে চকলেট, খুরমা খেজুর, কিশমিশ আর চিপস খেয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করলাম। মাল্লা ও নিমা শেরপা আমাদের উপরের অবস্থার কথা জানালেন। তাদের কথায়, উপরের অবস্থা ভালো না। তারা হাইক্যাম্পের পরের খাড়া দেয়ালটার ওপর পর্যন্ত দড়ি লাগিয়েছে। যখন তারা দড়ি লাগায় এবং রোড ওপেন করে তখন বাতাসের গতিও অনেক বেশি ছিল। তুষারপাতও হয়েছে অনেক। তুষার ধস হতে পারে যেকোনো সময়। তাই রাত ২টার মধ্যেই সামিট পুশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বিশ ডিগ্রির নিচে চলে এসেছে। পাশের পাহাড় থেকে থেমে থেমে রক ফল হচ্ছে। ছোট ছোট পাথরের টুকরো আমাদের তাঁবুতে এসে লাগছে। সবাই তখন আতঙ্কে। সময় যেন অলস গতিতে এগোচ্ছে। রাত ১২টা নাগাদ তুষার ঝড় থামল। আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। আমাদের এখনো দুই ঘণ্টা আছে। আমরা চা, বিস্কিট, খেজুর, কিশমিশ ও নুডলস খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছি। মনের ভিতর দারুণ উত্তেজনা। উপরে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে সবারই অজানা। আমরা সবাই প্রস্তুত। ন্যূনতম ভুল করা চলবে না। উত্তেজনায় বিপ্লব ভাই বলেই ফেললেন, ‘আমরা এখন যুদ্ধে যাচ্ছি। ভুল করা চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠিক এভাবেই প্রস্তুতি নিত মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণে যাওয়ার আগে।’ হ্যাঁ, তাই। আমরা আজ এখানে আছি এই লাল-সবুজের পতাকার জন্যই। যে পতাকার জন্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে। মাল্লা আমাদের জানালেন আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করছে। মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই আর নুর ভাই তাঁবু থেকে বের হয়ে দেখলেন নিচের দিক থেকে মেঘ অন্ধকার করে আসছে। দাফায় দফায় আমরা আলোচনা করছি। এই বিরূপ আবহাওয়ায় আমরা উপরে যাব কি না। আমাদের দলনেতা মুহিত ভাই সবার মতামত নিলেন। শেরপাও জানালেন ওপরের অবস্থা বিপজ্জনক। আবহাওয়া খারাপ হয়ে আসছে। প্রচণ্ড তুষারপাতের ফলে অ্যাভালান্সের ঝুঁকি খুবই বেশি। আর হাঁটুর উপর পর্যন্ত বরফ জমে আছে। তাই জীবনের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে তারা উপরে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাত তিনটা পর্যন্ত সামিট পুশ স্থগিত করা হলো। ভয়ঙ্কর নির্ঘুম রাত গেল। সকালে হাইক্যাম্প থেকে কাঠমান্ডুতে এজেন্সি ক্লাইমবালায়ার ডিরেক্টর মিংমার সঙ্গে মুহিত ভাইয়ের কথা হলো। তিনি জানালেন আগামী তিন দিন আবহাওয়া এমনই খারাপ থাকবে বলে জানিয়েছে নেপাল আবহাওয়া অফিস। তাই এখানে আবহাওয়া ভালো হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকার আর কোনো কারণ নেই। নিচে নামার পথে যেসব ক্রেভার্স দেখেছিলাম এখন সেগুলোও আর দেখা যাচ্ছে না। বরফে ঢেকে আছে। তাই নিচে নামার পথটা বিপজ্জনক হয়ে গেল। খুবই সতর্কতার সঙ্গে নামতে শুরু করলাম। উপরে ওঠার থেকে এখন নামাটা আরও বেশি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। যেখানে পা রাখি সেখানেই বরফ সরে যাচ্ছে। সফট ¯ন্ডেœা হওয়ায় অ্যাভালান্সের আশঙ্কায় প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ে কাটছিল। তাড়াহুড়া করে নামছিলাম আমরা। হঠাৎ মুহিত ভাইয়ের ডান পা দুই পাথরের ফাঁকে আটকে গেল। আমি, নুর ভাই ও বিপ্লব ভাই মিলে পাথরটি সরালাম। মুহিত ভাই পা বের করতে পেরে স্বস্তি পেলেন। এরপর আমরা আস্তে আস্তে বেসক্যাম্পে চলে এলাম। সবারই মন খারাপ। সামিট করা হলো না। সবাই দারুণভাবে অ্যাক্লামাটাইজ ছিলাম। দলের সবাই সুস্থ। শুধু আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় ফিরে আসতে হলো। উপরে আমরা প্রায় পনেরা ঘণ্টা ছিলাম। সেই পনেরো ঘণ্টার প্রতিটা মুহূর্ত ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। কিছু সময় মনে হয়েছে হয়তো ফিরতে পারব না। তখন খুব বেশি মনে পড়ছিল মা, বাবা ও ছোট দুই ভাইয়ের কথা। নিজের অজান্তেই চোখের জল গড়ায়। কিন্তু নামতে পারেনি, বরফ জমে গিয়েছিল গালে। আমাদের অভিযান অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ক্লাব বিএমটিসি এই অভিযান নিয়ে প্রায় ২৯টি অভিযান করেছে। ব্যর্থতা ও সফলতা দুটোর মুখই দেখেছে ক্লাবের অনেকে। ফিরে এসে বিখ্যাত পর্বতারোহী অ্যাডমুন্ড হিলারির কথা মনে পড়ে। তিনি বলেন- ‘I will come again & conquer you, because as a mountain you can’t grow but as a human, I can.’
শিরোনাম
- সিদ্ধিরগঞ্জে আহতদের পুনর্বাসন, জুলাই যোদ্ধাকে দোকান উপহার
- স্বাস্থ্যখাতে স্বনির্ভরতা অর্জনে সরকার কাজ করছে : আসিফ মাহমুদ
- নীলফামারীতে ৮৪৭টি মণ্ডপে হবে শারদীয় দুর্গাপূজা
- সিলেটে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে, বন্যার আশঙ্কা
- চট্টগ্রামে মানবতার সেতুবন্ধনে হবে ‘এসএমসিএইচ সামিট’
- মিরসরাইয়ে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার বাবাসহ সৎমা
- পানছড়িতে ভূতুরে বিদ্যুৎ বিল নিয়ে উত্তেজনা
- মাগুরায় চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে যুবক নিহত
- বগুড়ায় যৌথবাহিনীর অভিযানে মদ ও গাঁজা উদ্ধার, আটক ২
- মালয়েশিয়ায় ভূমিধসে ১৩ জনের মৃত্যু
- তিন মাসে শেষ হবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভূমি অধিগ্রহণ
- ‘অপারেশন প্যাসিফিক এঞ্জেল ২৫-৩’ পরিদর্শন করলেন ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন
- পাবনায় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের আবির্ভাব দিবস উদযাপন
- ভালুকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাইভেটকার চালক নিহত
- পঞ্চগড়ে সমতলের চা বাগানে পোকার আক্রমণ
- দিনাজপুরে মহিলা পরিষদের মানববন্ধন
- দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ঘাট সংকটে ভোগান্তি
- চট্টগ্রামে হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধার
- সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযান, গ্রেফতার ১৬৬১
- ভুয়া প্রমাণ হলে জুলাই যোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা
লারকে অভিযান শ্বাসরুদ্ধকর পনেরো ঘণ্টা
তুষারপাতের কারণে ক্রেভার্সগুলো ঢেকেও গেছে। পুরোটা পথ তুষারধসের এলাকা। হাইক্যাম্পে যাওয়ার শেষ চূড়াটা একটু বাঁক খাওয়ানো। বাঁকের পাশে বড় একটা বরফের ক্রেভার্স। এ পথে ফিক্সড রোপ লাগানো। এখানে পাথরের বোল্ডারও বেশি। তাই পথটাও বেশ ভয়ঙ্কর।
ইকরামুল হাসান শাকিল
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর