সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

দিল্লির বাঙালি ও মিডিয়া

গৌতম লাহিড়ী

দিল্লির বাঙালি ও মিডিয়া

ইতিহাসবিদরা বলেন, মুঘল আমল থেকেই দিল্লিতে বাঙালিদের আনাগোনা। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে রূপান্তরিত হওয়ার পর ‘বাবু’ বাঙালিদের প্রতিপত্তি। কলকাতা থেকে পঞ্চম জর্জ রাজধানী স্থানান্তরিত করলেন দিল্লিতে। ভারত স্বাধীন হলো। তার পর থেকে বাঙালি বসতি বাড়ল। ভারত ভাগ হওয়ার পর পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীরা আশ্রয় নিলেন দক্ষিণ দিল্লিতে। নাম ছিল ‘ইস্ট পাকিস্তান ডিসপ্লেসড পারসন কলোনি’। সংক্ষেপে ইপিডিপি। আজ যার পোশাকি নাম চিত্তরঞ্জন পার্ক। মিনি বেঙ্গল। বাঙালির বসবাস হলেই সাহিত্য-কলা-শিল্প চর্চা এক অভ্যাস। স্বাধীনতা-পূর্ব বা উত্তর-পর্বে রাজধানী দিল্লির গণমাধ্যম রীতিমতো শাসন করে আসছে বঙ্গতনয়রা। দিল্লিতে পাঞ্জাবি-বিহারির পর বাঙালি তৃতীয় সর্বাধিক কথিত ভাষা। নয় নয় করে ১৫ লাখের বেশি বাঙালির বসবাস দিল্লিতে। এক ডজন বাংলা বিদ্যালয়। শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, দিল্লি থেকে প্রভাতি বাংলা দৈনিক একটিও প্রকাশিত হয় না। এ কারণে রাজধানী দিল্লির নামজাদা সাংবাদিকরা হয় জাতীয় দৈনিকের, নতুবা কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্রের অথবা ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হয়েই কাজ করে আসছেন। এ কারণে রাজধানী দিল্লির বাংলা গণমাধ্যমের কোনো ইতিহাস নেই। অথচ জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাস রয়েছে। আমার প্রতিবেদনে সেই বাঙালির কথাই উল্লেখের প্রয়াস করছি। দিল্লির ইতিহাস ১৬৩৯ সালে শুরু। সম্রাট শাহজাহান সিদ্ধান্ত নিলেন আগ্রার পরিবর্তে যমুনা তীরের জনবসতিহীন লোকালয়ে গড়ে তুলবেন রাজধানী। ১৬৪৮ সালে শাহজাহান লালকেল্লায় বসবাস শুরু করলেন। তার আগে কেল্লা কেন্দ্র করে গড়ে উঠল নগর। শাহজাহানাবাদ। সেই নগরে তৈরি হলো রাজস্থান-পাঞ্জাব প্রদেশের হাভেলি এবং বাংলা বা বাংলো। বাঙালির কুটিরের আদলে তৈরি বাংলাকেই বাংলো বলা হয়। কোন বাঙালি গৃহনির্মাণকাররা তৈরি করেছিলেন তার সঠিক প্রমাণ নেই। তবে নিশ্চিত, বাঙালিরাই বসবাস করতেন।

এটা জানা গেছে, জয়পুরের রাজা দ্বিতীয় সোয়াই মান সিং বাংলার নৈহাটির ভাটপাড়ার বিদ্যাধর ভট্টাচার্যকে জয়পুর নগর পত্তনের দায়িত্ব দেন। তিনি রাজার হিসাবরক্ষক ছিলেন। সেটাই ছিল ভারতের প্রথম পরিকল্পিত প্রাসাদনগরী সাধারণ বাঙালিদের কাছে। বিশেষ পরিচয় তার নেই। কিন্তু জয়পুর শহরে বিদ্যাধরনগর এখনো রয়েছে। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের প্রথমেই বাঙালির উত্তর ভারতে আগমন। ১৮৩৭ সালে হুগলির চন্দননগরের উমাচরণ বসু এলাহাবাদ-কানপুর হয়ে দিল্লি এলেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বিভাগের কর্মী। বাংলা ছাড়াও উর্দু-আরবি-ফারসিতে পন্ডিত। মূলত অনুবাদকের কাজের জন্যই তাঁকে আনা হয়েছিল। মুঘলদের সঙ্গে আলোচনার জন্য। তাঁর আগে আরেক বিখ্যাত বাঙালি রাজদরবারে আসেন। তিনি রামমোহন রায়। মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের প্রতিনিধি হয়ে ব্রিটেন যান। তখনই তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেওয়া হয়।

তত দিনে বাঙালিদের বসবাস শুরু হলো। হিন্দু বাঙালি পরিবার নিবাস গড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমে গড়ে ওঠে কালীবাড়ি। কালীবাড়ি বাঙালি সংগীত-সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তিল হাজারিতে গড়ে ওঠে প্রথম কালীবাড়ি। প্রবাদ রয়েছে, সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা ৩০ হাজার গাছ পুঁতেছিলেন বলে এ স্থানের নাম হয় ত্রিশহাজারি বাগ। অন্য একটি মত হলো, সিপাহি বিদ্রোহের সময় এখানে ৩০ হাজার ভারতীয় সেনাকে বন্দী রাখা হয়েছিল বলে নাম হয় ত্রিশহাজারি। ত্রিশহাজারি কালীবাড়ি গড়েছিলেন সাধু কৃষ্ণানন্দ। প্রবাদ রয়েছে, সিপাহি বিদ্রোহের সময় অষ্টধাতুর কালীমূর্তিটি হারিয়ে যায়। পরে ব্রিটিশদের সাহায্যে তিনি নদীর জল থেকে মূর্তি উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তত দিনে ব্রিটিশদের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। কলকাতা থেকে বাঙালিদের আসতে বাধ্য করা হলো। ত্রিশহাজারির আশপাশে গড়ে উঠল সরকারি বাবুদের আবাসন। বাঙালিরা অনেকেই তত দিনে ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেছেন। সে কারণে তাঁদের দিল্লি নিয়ে আসা হয় প্রশাসনের কাজে সহযোগিতার জন্য। ব্রিটিশরা রেললাইন বিস্তার ঘটালেন। রেল কোম্পানির কারণেও বহু বাঙালি এলেন। ১৮৮০ সালের মধ্যেই দিল্লি শহরে উচ্চশিক্ষার কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে কারণেও অধ্যাপনার কাজে যোগ দিতে বহু শিক্ষিত বাঙালি দিল্লি এলেন। এঁরা অবসর সময়ে সাহিত্যচর্চা করতেন। তবে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেননি। সাহিত্য ম্যাগাজিন কিছু বেরোয়। জয়পুরে রাজ পরিবারের ‘দেওয়ান’ হয়েছিলেন সংসারচন্দ্র সেন। তাঁর নামেও জয়পুর শহরে রাস্তা রয়েছে। তিনি নিয়মিত দিল্লি আসা-যাওয়া করতেন। তাঁর অনুজ ভ্রাতা হেমচন্দ্র পেশায় চিকিৎসক। তিনি দিল্লি বেড়াতে এসে থেকেই গেলেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় চিকিৎসক। চাঁদনিচকেই তাঁর কোম্পানি ‘ডা. এইচ সি সেন কোম্পানি’। চাঁদনিচকে এখনো তাঁর নামে একটি রাস্তা রয়েছে।

হেমচন্দ্রের ভাগ্নে আশুতোষ রায়। তিনিই ডাক্তারবাবুর চেম্বারের পাশে খুলে ফেললেন ছাপাখানা। সেই ছাপাখানার নাম ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল প্রেস’। প্রথমে মামার দোকানের ক্যাশমেমো ইত্যাদি ছাপা শুরু করলেও পরে কিছু পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। ধরে নেওয়া যেতেই পারে, দিল্লিতে প্রথম প্রকাশনা। দিল্লিতে তখন বাঙালির সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৮৯৪ সালে খোলা হলো ‘বেঙ্গলি বয়েজ স্কুল’। সে স্কুলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল বঙ্গসাহিত্য সভা। কাশ্মীরি গেটের কাছে গড়ে ওঠা দিল্লির প্রথম বেঙ্গলি ক্লাব। একে ঐতিহ্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণার দাবি উঠেছে। এখানে নিয়মিতভাবে পালিত হয় পয়লা বৈশাখ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। প্রথম বাংলা গ্রন্থাগার।

দিল্লিতে প্রথম বাঙালির বসবাস শুরু হয় তিমারপুর, দরিবা কালান, সীতারাম বাজার, সদরবাজার, কাশ্মীরি গেট। কলকাতা থেকে সরকারি ছাপাখানা উঠে এলো মিন্টো রোডে। তত দিনে মুদ্রণশিল্পে বাঙালির নাম ভারতজোড়া। বাঙালির সংখ্যা বাড়তেই থাকল। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে। প্রথম গড়ে ওঠে বাঙালির নার্সিং হোম। মহাত্মা গান্ধী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ডা. সন্তোষ সেন প্রথম তাঁর মরদেহে ময়নাতদন্ত করেন। এখানেই এক বাঙালি সাংবাদিকের কথা ওঠে। শৈলেন্দ্রনাথ মুখার্জি। তিনি গান্ধীজির ছায়াসঙ্গী ছিলেন। সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি। গান্ধীজির শরীরে গুলি লাগার পর তিনি এতই আবেগপ্রবণ হয়ে যান যে সংবাদ পাঠাতেই ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁকে শাস্তি পেতে হয়েছিল কর্তব্যে গাফিলতির জন্য। এরপর দেশভাগের সময় ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা ভিড় করেন রাজধানীতে। যারা আন্দামান ও দন্ডকারণ্যে গেলেন না। পশ্চিম পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের জন্য দেওয়া হলো করোলবাগ আর বাঙালিরা পেলেন দক্ষিণ দিল্লির অধুনা চিত্তরঞ্জন পার্ক। সেটাই দিল্লির বাঙালিপাড়া। আজ আধুনিকতা এবং বেসরকারি গৃহনির্মাণের দৌলতে বাঙালিরা ক্রমেই সংখালঘু হয়ে পড়ছেন।

এখানেই গড়ে ওঠে ‘বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন’। এখন দিল্লি শহরের বাইরে উত্তর প্রদেশের নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা, হরিয়ানার ফরিদাবাদ, গুরগাঁওয়ে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়েছেন। দিল্লির বাঙালিদের বসতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা অমিতাভ রায়। তিনি যখন বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন তখন ‘দিগঙ্গন’ নামে একটি পত্রিকা চালু করেন। তাতে পশ্চিবঙ্গের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাড়াও সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হতো। এখানেও শরৎকালে যমুনার চরে কাশফুল দেখা মেলে। আকাশে উৎসবের মেজাজ। কিন্তু বাঙালিয়ানা প্রায় মুছতে বসেছে। নতুন প্রজন্ম মোটেই বাংলা ভাষা নিয়ে কোনো আবেগ দেখায় না। বাঙালি ছাত্রছাত্রী না পাওয়ায় বাংলা স্কুলগুলো ধুঁকছে। দিল্লির একমাত্র জাকির হুসেন কলেজে বাংলা বিভাগ রয়েছে। সেখানেও বিদ্যার্থী নেই। অধ্যাপনার পাশাপাশি মিহির গুহ রায় আংশিক সময়ের সাংবাদিকতা করতেন বাংলা সংবাদপত্রে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত। সাহিত্যে অনুরাগী ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল বাংলার সাহিত্যিকদের আড্ডা। কে না আসেননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টেপাধ্যায়সহ অনেকেই। তিনি মারা যাওয়ার পর দিল্লির সেই বাঙালি আড্ডা উধাও। ‘মেমসাহেব’ স্রষ্টা নিমাই ভট্টাচার্য সাংবাদিকতার কারণেই দিল্লি এসেছিলেন। তিনি বাঙালিদের রোমান্টিক নায়ক ছিলেন সাংবাদিকতার জগতে। প্রশ্নটা হলো, রাজধানী দিল্লিতে বাংলা গণমাধ্যম গড়ে উঠল না কেন? প্রথম কারণ বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা স্বয়ং বাঙালির। তা ছাড়া দিল্লির জনজীবনের সঙ্গে বাংলার কোনো ওতপ্রোত যোগাযোগ নেই। কলকাতার প্রথম সারির সংবাদপত্র আনন্দবাজার কয়েক মাস দিল্লি এডিশন চালু করেছিল। দেখাদেখি আরও কয়েকটি চালু হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সেসব বন্ধ হয়ে যায়। এক বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘সকালবেলা’ নামে একটি প্রভাতি দৈনিক চালু করে। মনে আছে উদ্যোক্তাদের আমিই নামকরণ করেছিলাম। তাও বন্ধ হয়ে গেল। ‘প্রবাসের খবর’ বলেও একটি সংবাদপত্র চালু ছিল কিছু দিন। সবারই আয়ু স্বল্প। রাজধানী দিল্লি থেকে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য যে পুঁজি লগ্নির প্রয়োজন তাতে কেউ আগ্রহ দেখাননি। অথচ দিল্লিতে দক্ষিণ ভারতের মালয়ালম সমাজের সংখ্যা নামমাত্র হওয়া সত্ত্বেও কেরালার প্রথম সারির সংবাদপত্র এখনো দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তবে বেশিদিন চলবে না তাও শোনা গেছে। রাজধানী দিল্লির গণমাধ্যমে বাঙালিদের দাপট অব্যাহত থাকলেও বাংলা গণমাধ্যমের অভাব আজও রয়ে গেল। তাই দিল্লির বাংলা গণমাধ্যামের কোনো ইতিহাস নেই। বাঙালি সাংবাদিকদের রয়েছে।

 

লেখক : সাংবাদিক (ভারত)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর