শনিবার, ২০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন প্রথম যেভাবে পালিত হয়েছিল

সুমন পালিত

প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন প্রথম যেভাবে পালিত হয়েছিল

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু যেমন সমার্থক শব্দ তেমন বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসই বাংলাদেশের ইতিহাস। ইতিহাসের এই মহানায়কের সঙ্গে সাক্ষাতের বিরল সুযোগ হয়েছিল ১৯৭০ সালে। ওই বছরের ১৬ ও ১৭ মার্চ। তারিখটি ঠিক ঠিক মনে আছে এক ভিন্ন প্রেক্ষিতে। ১৭ মার্চ হলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। স্বাধীনতার পর থেকে এ দিনটি দেশে-বিদেশে ঘটা করে পালন করা হলেও স্বাধীনতার আগে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সামাজিক রেওয়াজ হিসেবে আমাদের দেশের মুসলিম সমাজে সে সময় জন্মদিন পালন হতো না বললেই চলে। বঙ্গবন্ধু নিজেও তাঁর জন্মদিন পালনে ছিলেন উদাসীন। কাকতালীয়ভাবে ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর ৫০তম জন্মদিনে আমরা কেক কেটেছিলাম ঘটা করে। সে অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বাড়িতে কখনো কখনো জন্মদিন উপলক্ষে ভালো রান্নাবান্না হলেও কেক কাটার ঘটনা এটিই প্রথম। প্রকাশ্যে জন্মদিন পালনের ঘটনা কখনো তার চিন্তায়ও আসেনি। দুঃখ করে বলেছিলেন তার অনেক জন্মদিন কেটেছে কারা অন্তরালে।

১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের যে আয়োজনটি আমরা করেছিলাম সেটি ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অগোচরেই জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি তাতে হাজির হয়েছিলেন ভিন্ন উদ্দেশ্যে। খুলনা সফরকালে আওয়ামী লীগের একটি ইউনিয়ন কমিটির অফিস উদ্বোধন করতে। একজন জাতীয় নেতার জন্য এ ধরনের ছোট অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া অভাবনীয় মনে হলেও ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে কথা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের সে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের একজন হিসেবে সে স্মৃতি আজ তুলে ধরছি। ১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ। দেশে তখন জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন জেনারেল আইয়ুব খান। স্বঘোষিত এই ‘ফিল্ড মার্শাল’ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে। ইয়াহিয়া ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে জয়ী হবে যারা, তারা সরকার গঠন করবে। নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রণয়ন করবে দেশের সংবিধান। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ’৭০-এর প্রথম দিকে রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন। অনুমতি দেন ঘরোয়া রাজনীতির। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু আসেন খুলনা সফরে। আমরা তখন খুলনার শেখপাড়া এলাকার অধিবাসী। বঙ্গবন্ধুর সফরসূচিতে শেখপাড়ায় নজরুলনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অফিস উদ্বোধনের কথা ছিল। উদ্বোধনের দিনটি ছিল ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। কিন্তু পরিস্থিতিগত কারণে তিনি এ কর্মসূচি বাতিল করেন। এর আগে ১৫ অথবা ১৬ মার্চ খুলনার পৌর মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের কর্মিসভা হয়। মিলনায়তনের বাইরেও জড়ো হয় অন্তত ১০ হাজার সমর্থক। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রকাশ্য সমাবেশের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা কৌশলগত কারণে মেনে চলতেই আগ্রহী ছিলেন। যে কারণে কর্মিসভাটি তড়িঘড়ি শেষ হয়। খুলনায় বঙ্গবন্ধুর অন্য যে কর্মসূচি ছিল সেগুলোও বাতিল হয় ঘরোয়া রাজনীতির সীমালঙ্ঘিত হতে পারে এমন আশঙ্কায়। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। ওই কিশোর বয়সেই স্বাধীনতাকামী একটি গোপন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যার নেতৃত্বে ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দ্বিতীয় আসামি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রকাশ্যে এ গ্রুপটি কাজ চালাত লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির নামে। এ গ্রুপটির সঙ্গে পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ছিল। কর্মীদের বেশিরভাগ প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করতেন। ছাত্র কর্মীরা ছাত্রলীগে। সে সূত্রে ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল।

সবারই জানা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন নস্যাৎ করতে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করে। প্রধান আসামি করা হয় তাকে। এ মামলার ২ নম্বর আসামি করা হয় পাকিস্তান নৌবাহিনীর স্বাধীনতাকামী বাঙালি অফিসার লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা। তাদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। এদেশের মানুষ আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানকে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাও প্রত্যাহার করা হয় গণদাবির মুখে।

বলছিলাম বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের কথা। সে সময় নজরুলনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মোশাররফ হোসেন। সাধারণ সম্পাদক শেখ মোসলেম উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু মোশাররফ ভাইকে স্নেহ করতেন বিশেষভাবে। যে কারণে জাতীয় নেতা হয়েও খুলনা সফরকালে নজরুলনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অফিস উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজি হন। নজরুলনগর ছিল মুসলিম লীগের ঘাঁটি। বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি বাতিলের ঘটনা স্থানীয়ভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে ভেবে নেতা-কর্মীরা ভেঙে পড়েন। আগেই বলেছি, মোশাররফ ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন। অনেক বড় নেতার চেয়েও পেশায় দর্জি, বেঁটে-খাটো এই স্বল্পশিক্ষিত মানুষটিকে তিনি বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। মোশাররফ ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন যেভাবেই হোক শেখপাড়ার কর্মসূচি বহাল রাখতে হবে। মোসলেম মেম্বারকে নিয়ে তিনি এলেন আমাদের বাড়িতে। বললেন, তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে যাচ্ছেন। আমাকেও যেতে বললেন। আওয়ামী লীগের মরহুম নেতা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাহউদ্দিন ইউসুফ ছিলেন তখন খুলনা সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার বাসভবনে বঙ্গবন্ধু জেলার শীর্ষ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। আমরা গেলাম সেখানে। মোশাররফ ভাইয়ের জেদেরই শেষ পর্যন্ত জয় হলো। বঙ্গবন্ধু পরদিন শেখপাড়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে রাজি হলেন। বললেন তিনি আমাদের অনুষ্ঠানস্থলের খুব কাছেই থাকবেন। মাগরিবের নামাজ পড়ে সাড়ে ৬টা নাগাদ হাজির হবেন।

বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ফিরে এসে আমরা বৈঠকে বসলাম। মোসলেম ভাই প্রস্তাব দিলেন ১৭ মার্চ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সেহেতু অনুষ্ঠানে কেক কাটা হবে। খুলনার হুগলি বেকারিতে অর্ডার দিয়ে ৫০, ৭৫ কিংবা ১০০ টাকা দিয়ে বেশ বড় আকারের একটি কেক কেনা হলো। মোসলেম ভাইয়ের একটি কবিতাও লেখা হয় কেকটিতে। যাতে ৬ দফার প্রণেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাংলাদেশ, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মুক্তিকামী জনতার নেতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ঠিক সন্ধ্যার পর এলেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের বাড়ির পাশেই আওয়ামী লীগ অফিস। অফিসটি আগে ছিল একটি গোডাউন। সামনে বেশ প্রশস্ত খোলামেলা জায়গা। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা দেবদারু পাতার আকর্ষণীয় তোরণ বানিয়েছিলাম। মূলত আমাদের বন্ধু আশরাফ দেবদারু পাতার ওই তোরণটি তৈরি করেছিলেন। তোরণটি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, বঙ্গবন্ধু কিছুটা সময় থমকে দাঁড়ান। আমাদের মাথায় হাত দিয়ে বাহবাও দেন।

বঙ্গবন্ধু খুলনার ডালমিলের মোড়ে তার ভাগ্নে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর (চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী ও সংসদ সদস্য লিটন চৌধুরীর বাবা) বাসভবনে অবস্থান করছিলেন। মাগরিবের নামাজ পড়ে তিনি অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। বঙ্গবন্ধু অনুষ্ঠানস্থলে আসার আগে সেখানে সবমিলে ২০-২৫ জন কর্মী ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সহস্রাধিক লোকের ভিড় জমে ওঠে। অফিসের সামনে একটি টেবিলে রাখা ছিল কেকটি। অফিস উদ্বোধনের ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু সবার অনুরোধে কেক কাটেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খ- করে তা বিতরণ করা হয় নেতা-কর্মী সমর্থকদের মধ্যে। প্রচ- ভিড়ে লোকজন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাচ্ছিল না। তারা দাবি জানাল বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চায়। বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে বললেন, আমি তো আইয়ুব খানের চেয়েও লম্বা। তিনি সবার অনুরোধে কিছুটা উঁচুস্থানে দাঁড়িয়ে মিনিটখানেক শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখলেন। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানালেন। অনুষ্ঠান শেষে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে চা-চক্রে মিলিত হন বঙ্গবন্ধু। কথা প্রসঙ্গে বলেন, প্রকাশ্যে তার জন্মদিন পালন এটিই প্রথম। স্মৃতিচারণ করেন, অনেক জন্মবার্ষিকী কেটেছে কারা প্রকোষ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর এই অনন্য ‘জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান’-এ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ, শেখ আবদুল আজিজ, সালাহউদ্দিন ইউসুফসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে যাদের একেকজন দিকপাল হিসেবেই বিবেচিত।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর