বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

নারী যখন কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট নয়

ব্যারিস্টার সুমাইয়া আজিজ, প্যানেল ল ইয়ার, বাজুস

নারী যখন কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট নয়

অলংকার শব্দটির অর্থ ভূষণ বা গয়না। সংস্কৃত শব্দ অলম থেকে অলংকার শব্দটির আবির্ভাব হয়েছে বলে মনে করা হয়। অমরসিংহ রচিত সংস্কৃত অভিধানে ‘অলম’ শব্দটি পর্যাপ্ত শক্তি, বরণ-বাচকের সঙ্গে ভূষণ অর্থ বহন করে। প্রাচীন যুগের জনৈক ঋষি বলেন, ‘নারী যখন কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট নয়, তখন তাকে অলংকার দেওয়া হলো এবং সে বলল- অলম, যার অর্থ আর নয়। অর্থাৎ একমাত্র অলংকারই তাকে সম্পূর্ণ করতে পারে, তার সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দিতে পারে। প্রাচীনতার এ ধারাবাহিকতায় আজ পর্যন্ত অলংকার মানুষের সাজসজ্জায় সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের সম্মিলন ঘটিয়ে চলেছে।

অলংকার ব্যবহারের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয়, ১ লাখ ১৫ হাজার ৯৩ বছর আগে ইউরোপীয়রা হাড়, কাঠ, সামুদ্রিক ঝিনুক, শামুক, পাথর ব্যবহার করে অলংকার তৈরি করতেন। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৬ হাজার ৫০০ বছর আগের মাদুলি আকৃতির একটি অলংকার পাওয়া গেছে পাকিস্তানের মেহেরগড়ে প্রাক-মৃৎশিল্পের স্তর থেকে। সবচেয়ে পুরনো স্বর্ণের তৈরি অলংকারটি পাওয়া যায় পাকিস্তানের আলিপুরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার ৫০০ সালের। সিন্ধু উপত্যকায় বিশেষ করে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় স্বর্ণালংকারের বহু ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ২৯৬ সালে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পুণ্ড্র (বগুড়া) ও ত্রিপুরায় (কুমিল্লা) রুপা ব্যবহারের কথা জানা যায়।

স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক দেশেই গোল্ড এক্সচেঞ্জ পলিসি আছে, আছে গোল্ড ব্যাংক। আমাদের দেশেও গোল্ড এক্সচেঞ্জ ও গোল্ড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশে প্রথম গোল্ড রিফাইনারি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে গোল্ড এক্সচেঞ্জ পলিসি ও গোল্ড ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠবে
বাংলাদেশে গুপ্ত শাসনামলে (আনুমানিক ৩২০ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব) স্বর্ণালংকারের প্রচলন ছিল। সে সময় নারী-পুরুষরা শরীরের ওপরের অংশে কোনো পোশাক পরতেন না। ধনীরা নানারকম অলংকার দিয়ে শরীর ঢেকে রাখতেন। ১৫১৪ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন পর্তুগিজ পর্যটক দুর্তে বারাবো। তিনি বাংলায় সোনা-রুপার ব্যবসার কথা বলেছেন। মালাক্কার তুলনায় বাংলাদেশে সোনার দাম ছয় ভাগের এক ভাগ বেশি হওয়ায় এবং বাংলা থেকে মালাক্কায় রুপা নিয়ে গেলে তার দাম চার ভাগের এক ভাগ হওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ীরা সোনা-রুপার ব্যবসায় বেশি আগ্রহী হতেন।

আমাদের দেশে অলংকারের বহুল প্রচলন রয়েছে। অলংকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুস। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার জুয়েলারি ব্যবসায়ী রয়েছেন। বাজুস স্বর্ণ ব্যবসার মানোন্নয়ন ও তার আন্তর্জাতিকীকরণে ব্যাপক তৎপর রয়েছে।

আমাদের দেশের স্বর্ণশিল্পীদের হাতের কাজের সুনাম বিশ্বজুড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে হাতে তৈরি সোনার গহনার কদর বাড়ছে দিন দিন। এশিয়ার বহু দেশ সোনার গহনা ব্যবসায় নিযুক্ত। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি গহনার বিপুল চাহিদা রয়েছে। হস্তজাত সোনার গহনার প্রায় ৭০ শতাংশ বাংলাদেশ ও ভারতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে, সোনার অলংকার বিদেশে রপ্তানিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে। ভারত বিদেশে সোনার অলংকার রপ্তানির মাধ্যমে বেশ ভালো পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে থাকে। বাংলাদেশ এখনো হস্তজাত স্বর্ণের সম্ভাবনা আশানুরূপ কাজে লাগাতে পারেনি। এ সম্ভাবনা কাজে লাগালে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

সাধারণত বহির্বিশ্ব থেকে আসা স্বর্ণ দিয়ে অলংকার তৈরি করা হয়। অদূর ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে স্বর্ণের বার না এনে আমাদের দেশেই গোল্ড রিফাইনারি স্থাপনের মাধ্যমে স্বর্ণের বার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে উৎপাদিত স্বর্ণের বারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ খোদাই করা থাকবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে এ দেশের সোনার ব্র্যান্ডকে সুপরিচিত করতে ভূমিকা রাখবে। এ বৃহত্তর বিনিয়োগটির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম গোল্ড রিফাইনারি স্থাপন করতে যাচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপ। এতে স্বর্ণ ব্যবসা ও স্বর্ণ প্রস্তুত কারখানার বিকাশ ঘটবে সন্দেহাতীতভাবে। অপরিশোধিত স্বর্ণ/আকরিক/আংটি পরিশোধিত স্বর্ণ নিজস্ব প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে পরিশোধন করার ফলে শিল্পায়নের এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। রিফাইনারি দেশের তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশের নাম। যা একই সঙ্গে দেশের সুনাম, মর্যাদা ও অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। দেশের অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী জুয়েলারি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন।

আগে আমাদের দেশে স্বর্ণ ব্যবসার নীতিমালা ছিল না। ২০১৮ সালে সরকার স্বর্ণ ব্যবসার সম্ভাবনার গুরুত্ব মাথায় রেখে স্বর্ণ নীতিমালা (এড়ষফ চড়ষরপু) প্রণয়ন করে, যা ২০২১ সালে সংশোধিত হয়ে ‘স্বর্ণ নীতিমালা (সংশোধিত), ২০২১’ নামে অভিহিত হয়েছে। এ নীতিমালার ফলে স্বর্ণশিল্প বিকাশের পথ অনেকটা সুগম হয়েছে। নীতিমালা অনুসারে, নিবন্ধিত বৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা স্বর্ণালংকার রপ্তানিকারক সনদ নিতে পারবেন। বৈধভাবে স্বর্ণালংকার রপ্তানিতে উৎসাহিত করতে রপ্তানিকারককে স্বর্ণালংকার তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনামূলক বিশেষ সহায়তা দেওয়া হবে।

স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক দেশেই গোল্ড এক্সচেঞ্জ পলিসি আছে, আছে গোল্ড ব্যাংক। আমাদের দেশেও গোল্ড এক্সচেঞ্জ ও গোল্ড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশে প্রথম গোল্ড রিফাইনারি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে গোল্ড এক্সচেঞ্জ পলিসি ও গোল্ড ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠবে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার স্বর্ণ ব্যবসার সম্ভাবনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে যেমন স্বর্ণ নীতিমালা, ২০২১ প্রণয়ন করেছে তেমনি আর একটি বিষয় সরকারকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। তা হলো, জুয়েলারি শিল্পে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স অর্থাৎ মূল্য সংযোজন কর অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। এটা না কমালে এ শিল্পের সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হবে নিঃসন্দেহে। বর্তমান সরকার দেশে বিভিন্ন বাণিজ্য সম্ভাবনার আন্তর্জাতিকীকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। আশা করি স্বর্ণ ব্যবসায় ভ্যাটের উচ্চহার প্রশমনেও সুবিবেচনাপ্রসূত আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট হবে; যা দেশের স্বর্ণ ব্যবসার সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করবে এবং দেশের স্বর্ণের বাজার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

সর্বশেষ খবর