রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সিনেমার যত জমকালো পুরস্কার

তানভীর আহমেদ

সিনেমার যত জমকালো পুরস্কার

রুপালি পর্দার জগৎ নিয়ে মানুষের কৌতূহল কম নয়। পর্দায় নায়ক-নায়িকার রসায়ন দেখে দর্শকরা বিনোদিত হন। আবেগের সাতরঙা আকাশে দর্শকদের মেঘের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যান পরিচালক। গল্পকার, চিত্রনাট্যের জাদুতে কখনো বাস্তবের প্রতিচ্ছবি, কখনো কল্পলোকে মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে নতুনভাবে। সিনেমা শুধু বিনোদনই দেয় না, কখনো মনের ভিতরে তৈরি করে মানবিক বোধ। মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে। মানুষের ভিতরের আবেগ নিয়ে পরিচালক সত্যিকারের ম্যাজিশিয়ানের মতো খেলে যান ইচ্ছামতো। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি সিনেমার দর্শক মুখিয়ে থাকেন সেরা সিনেমার স্বাদ পেতে। সেরা কাজের মূল্যায়ন ও প্রেরণা জোগাতে সাহায্য করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সিনেমাপ্রেমী, সিনেমাবোদ্ধা ও সিনেমা নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতি বছর এ ধরনের কিছু পুরস্কার প্রদান করে থাকে। তেমনই কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসব ও পুরস্কারের কথা নিয়ে আজকের রকমারি—

 

কান চলচ্চিত্র উৎসব

চলচ্চিত্রপ্রেমীদের তীর্থস্থান কান। কান একটি শহরের নাম। এটি রয়েছে ফ্রান্সে। এখানেই প্রতি বছর বিশ্বের প্রথমসারির চলচ্চিত্র, অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, সংগীতশিল্পী থেকে শুরু করে সিনেমার সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীরা উপস্থিত হন। কান চলচ্চিত্র উৎসবকে বলা হয় সিনেমা জগতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর। এই উৎসবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সারা বিশ্বের খ্যাতনামা পরিচালকদের সেরা কাজ প্রদর্শিত হয়ে থাকে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রী ও পরিচালকদের পদভারে সরগরম হয়ে ওঠে কান শহর। ১৯৪৬ সাল থেকে প্রতি বছর এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের রিজোর্ট শহর কানে প্রতি বছর সাধারণত মে মাসে এটি পালিত হয়। কান উৎসবে পাম ডি’অর পুরস্কার প্রদান করা হয় সেরা কাজের মূল্যায়ন হিসেবে। ফরাসি ভাষায় পাম দোর-এর অর্থ ‘স্বর্ণ পাম পাতা’। অনেকে ইংরেজিতে গোল্ডেন পাম বলে থাকেন। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এ নামে কোনো পুরস্কার ছিল না। ১৯৫৫ সালে প্রথম পাম ডি’অর পেয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান মার্কিন চলচ্চিত্রকার ডেলবার্ট মান।

 

বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব

আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র উৎসবের কথা এলে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা অস্কার ও ব্রিটিশ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা বাফটা পুরস্কার— দুটোকে ঘিরেই সমালোচনা রয়েছে পুরস্কারের যোগ্য সিনেমার পরিসর নিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যকেই এগিয়ে রাখেন। যে কারণে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতোই জার্মানির বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের বাড়তি মর্যাদা রয়েছে। এ উৎসবে জয়ী শিল্পীর হাতে ওঠে গোল্ডেন বিয়ার বা স্বর্ণের ভাল্লুক। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব সত্যিকার অর্থেই সারা বিশ্বের সেরা সিনেমা ও সিনেমা জগতের কলাকুশলীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এই সিনেমাপাড়ার উৎসবের খবর ফলাও করে প্রচার করে থাকে। ১৯৭৮ সাল থেকে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পাবলিক অ্যাটেনডেন্ট বা সাধারণ মানুষের উপস্থিতি এই চলচ্চিত্র উৎসবে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দিক। প্রায় ৩ লাখ টিকিট বিক্রি হয় এই উৎসবের এবং আরও ৫ লাখ আবেদন পড়ে এই উৎসবের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য।

 

একাডেমি অ্যাওয়ার্ড

১৯২৯ সাল থেকে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলস থেকে এই পুরস্কার প্রদান করে থাকে ‘একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস’। অনেকে এই পুরস্কারকে অস্কার পুরস্কার বলেই বেশি চেনেন। সিনেমা জগতের অন্যতম প্রধান মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার এটি। হলিউডের সিনেমার প্রাধান্য থাকায় সমালোচকরা প্রায়শই অস্কারকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত পুরস্কার মানতে নারাজ। তবে মিডিয়ার বদৌলতে অস্কার পুরস্কারের আয়োজন বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে থাকে। সিনেমার পরিচালক, অভিনেতা, লেখকদের কাজকে সম্মান জানিয়ে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এ ছাড়া আরও একাধিক ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি উপভোগ করে থাকেন। অস্কারজয়ী পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, লেখক ও সংগীত পরিচালকরা বিশ্বজুড়েই সম্মানিত হয়ে থাকেন। তাই সিনেমা জগতে এই পুরস্কারের বাড়তি মর্যাদা রয়েছে।

 

ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড

ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড মূলত ব্রিটিশ একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড  টেলিভিশন আর্টস-এর সিনেমা জগতে সম্মাননা প্রদান করে থাকে। বাফটা পুরস্কার নামে এক নামে চেনে বিশ্ববাসী। বাফটা অ্যাওয়ার্ড ১৯৪৯ সাল থেকে নিয়মিত প্রদান করা হয়ে থাকে। ১৯৫৮ সালে বাফটা টেলিভিশন প্রযোজক ও পরিচালকদের সঙ্গে এক হয়ে যায়। এর উদ্দেশ্য ছিল, সিনেমা ও টেলিভিশনের সার্বিক অনুষ্ঠান এবং সিনেমা জগতের উন্নয়ন। সেরা সিনেমা হিসেবে বাফটা পুরস্কার প্রাপ্তি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ মর্যাদা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাফটা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে সম্মানজনক ফিল্ম পুরস্কার। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে এ পুরস্কার প্রদান করা হয় লন্ডনে। ২০০৮ সাল থেকে সেন্ট্রাল লন্ডনের রয়েল অপেরা হাউসে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশ্বের নামিদামি ফিল্ম মিডিয়া জগতের কলাকুশলীরা এখানে আমন্ত্রিত হয় থাকেন। বাফটাকে যুক্তরাজ্যের অস্কার বলেও মানা হয়। এখন বাফটা সিনেমা, টেলিভিশন অনুষ্ঠান ছাড়াও ভিডিও গেম ও এনিমেশন মুভি ক্যাটাগরিতেও পুরস্কার প্রদান করে থাকে।

 

ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব

কান ও বার্লিনের পর ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব সত্যিকার অর্থেই জমে ওঠে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অপেক্ষা করে এই চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বশেষ খবরটি জানতে। ইতালির ভেনিস শহরে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এখানে প্রদর্শিত সিনেমার বৈচিত্র্য। প্রতিটি চলচ্চিত্র উৎসবেই এই বৈচিত্র্য ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে বলা হয় সেই বৈচিত্র্য উপভোগের সবচেয়ে সুন্দর আয়োজন। ফিচার ফিল্ম প্রদর্শনের দিক দিয়ে এই উৎসব সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছে। এশিয়ান হোক বা ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ফিল্ম পছন্দ করেন তাতেও পিছিয়ে নেই তারা। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব মাতিয়ে দিতে পারে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো পরিচালক, অভিনয়শিল্পীর সিনেমা। আগে থেকেই কোনো সিনেমা ভেনিস জয় করে ঘরে ফিরবে সেটা অনুমান করা কঠিন বলেই এই চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে মানুষের বাড়তি কৌতূহল থাকে। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব বিজয়ী হাতে তুলে নেন গোল্ডেন লায়ন বা সোনার সিংহ।

 

দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার

হলিউড আর বলিউডের উত্তাপ এ দেশে কম নয়। ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির রোজকার খবর রাখেন সবাই। ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক বলে পরিচিত ফালকে ছিলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার নামানুসারে প্রবর্তিত এই সম্মাননা শুধু ভারতের সিনেমার জন্য হলেও এর মর্যাদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ডিরেক্টরেট অব ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এ পুরস্কার প্রদান করে থাকে। এটি ভারত সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এ সংস্থাটি সিনেমার সঙ্গে যুক্ত পরিচালক, অভিনয় শিল্পীদের পুরস্কার প্রদান করা ছাড়াও ভারতীয় চলচ্চিত্রের আধুনিকায়ন ও প্রগতির জন্য অবদান রেখে থাকে। দেশের সম্মানীয় ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব দ্বারা গঠিত একটি কমিটি এ পুরস্কারের যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করে থাকে। বিজেতা পুরস্কার হিসেবে পান একটি স্বর্ণকমল পদক, নগদ ১০ লাখ রুপি ও একটি শাল। ভারতীয় চলচ্চিত্রে দাদাসাহেব ফালকের অবদানের স্বীকৃতিতে ভারত সরকার ১৯৬৯ সালে প্রথম এই পুরস্কারের প্রচলন করে।

সর্বশেষ খবর