জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নতুন নতুন আবিষ্কার প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অভূতপূর্ব বিকাশ ও আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে জ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। সময়ের ধারাবাহিকতা ও আবিষ্কারের নেশায় মুসলিম জ্ঞান-সাধকরা পিছিয়ে ছিলেন না। তারা নিজ মেধা-মননে বিশ্বদরবারে নিজেদের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্বখ্যাত কয়েকজন মুসলিম জ্ঞান-সাধক ও বিজ্ঞানীর কথা লিখেছেন- মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ। আজ রইল প্রথম পর্ব।
জাবের ইবনে হাইয়ান
পুরো নাম আবু মুসা জাবের ইবনে হাইয়ান। তাঁকে ‘রসায়নের জনক’ বলা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে রসায়নবিদ, আলকেমিবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, দার্শনিক, পদার্থবিজ্ঞানী, ওষুধ বিশারদ ও চিকিৎসক। তাঁর প্রকৃত জাতীয়তা জানা যায়নি। তবে অনেকের ধারণা, তিনি ইরানের তুস অঞ্চলের নাগরিক ছিলেন। ৭২১ সালে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন ওষুধ প্রস্তুতকারক। প্রাথমিক শিক্ষা বাবার কাছেই। এরপর জাফর সাদিকের কাছে আলকেমি ও চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বাবার মতো বেছে নেন ওষুধ প্রস্তুতের পেশা। ধীরে ধীরে জ্ঞানবিজ্ঞান, গবেষণা ও আবিষ্কারে পা রাখেন। তিনি রসায়নে অমর কীর্তি রেখেছেন। রসায়নশাস্ত্রে সময়োপযোগী অনেক কিছু আবিষ্কার করেন। ইস্পাত তৈরি, লোহার মরীচিকা রোধ, অলংকারের মসৃণ খোদাই, কাপড় রং করার প্রণালি, চামড়ার টাংকি, বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থসংশ্লিষ্ট কার্যকরী বস্তুর আবিষ্কার তাঁর হাতে। তাঁর লেখা বই ‘বুক অব স্টোনস’-এ কৃত্রিম কাঁকড়া, সাপ এমনকি রোবট তৈরির প্রণালির উল্লেখ রয়েছে। তিনি কুফায় একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে গবেষণা করেন। তাঁকে পৃথিবীর ‘সর্বপ্রথম রসায়ন বিজ্ঞানী’ বলা হয়। তিনি হাজার দুয়েক বই লিখেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে রসায়নে ২৬৭টি, যুদ্ধাস্ত্রাদিতে ৩০০টি, চিকিৎসাবিজ্ঞানে ৫০০টি, দর্শনে ৩০০টি, দার্শনিক ও যুক্তিখণ্ডনবিষয়ক ৫০০টি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে রসায়নবিষয়ক রচনা তাঁকে অমর করে রেখেছে। ১০ বছর গৃহবন্দি থেকে আনুমানিক ৮১৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
আল-কিন্দি
পুরো নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি। তাঁকে ‘ক্রিপ্টোগ্রাফি ও পেরিপ্যাটেটিক দর্শনের জনক’ বলা হয়। তিনি একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ, রসায়নবিদ, যুক্তিবিদ, গণিতজ্ঞ, সঙ্গীতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও আবহাওয়াবিজ্ঞানী ছিলেন। আনুমানিক ৮০১ সালে ইরাকের কুফা শহরে তাঁর জন্ম। নবম শতাব্দীতে তিনি আরবি অনুবাদের মাধ্যমে গ্রিক দর্শন, গণিত, নিওপ্লাটোনিস্ট ও এরিস্টটলের কাজগুলোকে মুসলিম জগতে প্রচার করেন। এরিস্টটলের মেটাফিজিস্ক বা তত্ত্বকথার আরবি অনুবাদ করেন তিনি। বিশ্বজগতের রহস্য উদ্ঘাটনের যে কার্যকারণ-তত্ত্ব তা ব্যাখা করেন। তাঁর মতে, এ জগতের কোনোকিছুই স্থায়ী নয়। স্রষ্টা নিজ ইচ্ছায় গড়েছেন, নিজ ইচ্ছায় তা ধ্বংস করবেন। তিনি প্রথম ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতিকে মুসলিম ও খ্রিস্টান বিশ্বে পরিচিত করেন। কয়েকটি নতুন গাণিতিক পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন। যার মধ্যে কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানকে ব্যবহার করে তিনি ওষুধের কার্যকারিতা পরিমাপক যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তিনি মনে করতেন, সঠিক দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হবে। এজন্য তিনি দর্শনে গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন। অনেক গবেষকের মতে, তিনি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। দর্শনশাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ‘দ্য আরব ফিলোসফার’ বলা হয়। আনুমানিক ৮৭৩ সালে প্রায় ৭২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
ইবনে বতুতা
পুরো নাম শেখ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা। তিনি ছিলেন মুসলিম পর্যটক, চিন্তাবিদ, বিচারক ও বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৩০৪ সালে মরক্কোর তানজাহ প্রদেশের তাঞ্জিয়ারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন কাজি। ছোটবেলা থেকেই ইবনে বতুতা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় পরিব্রাজক হওয়া এবং মিসর, সিরিয়া ও হেজাজ অঞ্চলের খ্যাতনামা আলেমদের অধীনে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করা। ফলে পরবর্তীতে বিভিন্ন ইসলামি রাজ্য তাঁকে কাজি মনোনীত করে। ২০ বছর বয়সে তিনি বেরিয়ে পড়েন বিশ্ব ভ্রমণে। টানা ৩০ বছর ঘুরে বেড়ান বিশ্বের নানা প্রান্ত। এ সময় তিনি সব মুসলিম সাম্রাজ্য মিলে ১ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার সফর করেন। সেসব অঞ্চলের শাসকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ দীর্ঘ পথ ভ্রমণের পর যখন মরক্কোতে ফেরেন তখন সুলতান আবু ইনান ফারিস ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্য তাঁকে তাগাদা দেন। তাঁর সমগ্র ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্য সাহায্যকারী হিসেবে কবি ইবনে জুজাই আল-কালবিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৩৫৫ সালে তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘রিহলা’ নামে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল ১৪ শতকের আগে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক দলিল। বইটি ১৯৫৮ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। তাঁর ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থা এবং নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জানা যায়। ১৩৬৮ বা ১৩৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
আল বিরুনি
পুরো নাম আবু রায়হান আল বিরুনি বা আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বিরুনি। তাঁকে ‘ইন্ডোলজির প্রতিষ্ঠাতা, তুলনামূলক ধর্ম ও আধুনিক জিওডেসির জনক এবং প্রথম নৃতত্ত্ববিদ’ বলা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে বহু ভাষাবিদ, গণিত ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ; রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। এ ছাড়া ছিলেন ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, পঞ্জিকাবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক। স্বাধীন চিন্তা, মুক্ত বুদ্ধি, সাহসিকতা, নির্ভীক সমালোচনা ও সঠিক মতামতের জন্য তিনি যুগশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর শেষার্ধ ও পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমার্ধকে ‘আল বিরুনির কাল’ বলা হয়। উজবেকিস্তানের খাওয়ারিজমে আনুমানিক ৯৭৩ সালে তাঁর জন্ম। তিনি সুদীর্ঘ ২২ বছর রাজকীয় অনুগ্রহে কাটিয়েছেন। তাঁর সময়কার বড় বড় বিদ্বান ব্যক্তির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। অধ্যয়নকালে তিনি তাঁর কিছু প্রাথমিক রচনা প্রকাশ করেন। আরবি ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তাঁর মাতৃভাষা ছিল খাওয়ারিজমি আঞ্চলিক ইরানি ভাষা। কিন্তু তিনি তাঁর রচনাবলি আরবিতে লিখে গেছেন। জীবনের শেষ দিকে কিছু বই ফার্সিতে বা আরবি ও ফার্সি উভয় ভাষায় লিখেন। তিনি গ্রিক ভাষাও জানতেন। হিব্রু এবং সিরীয় ভাষায়ও তাঁর দক্ষতা ছিল। তিনি অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। শহরের বাইরে বাস করতেন বলে ‘আল বিরুনি’ নামে পরিচিতি পান। তাঁর লেখা ১৪৬টি বইয়ের মধ্যে ৯৫টি জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও গাণিতিক ভূগোলের মতো সম্পর্কিত বিষয়ে রচিত। আনুমানিক ১০৫০ সালে ৭৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
ওমর খৈয়াম
পুরো নাম গিয়াসউদ্দিন আবুল ফাতাহ ওমর ইবনে ইবরাহিম আল খৈয়াম নিশাপুরি। তিনি ছিলেন ইরানের বিখ্যাত কবি, গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ। ইসলামি বর্ষপঞ্জি সংস্কারেও তাঁর অবদান রয়েছে। ফার্সি কাব্যজগতে তিনি এক বিশেষ চিন্তাধারা ও বিশ্বদৃষ্টির পথিকৃৎ ছিলেন। বিশ্ব সাহিত্যেও অনন্য বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৮ মে ১০৪৮ সালে ইরানের খোরাসান অঞ্চলের নিশাপুরে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন মালিক শাহ সেলজুকের সমসাময়িক। ওমর খৈয়ামের শৈশব কেটেছে অধুনা আফগানিস্তানের বালখ শহরে। তাঁর বাবা ছিলেন তাঁবুর কারিগর ও মৃৎশিল্পী। বিখ্যাত দার্শনিক মুহাম্মদ মানসুরির কাছে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন তিনি। দীক্ষা নিয়েছেন ধর্মীয় শাস্ত্র, দর্শন ও গণিতে। তিনি দিনে বীজগণিত ও জ্যামিতি পড়াতেন। সন্ধ্যায় মালিক শাহের দরবারে পরামর্শ দিতেন। তাঁর দিনগুলো দারুণ কাটছিল। কিন্তু আঁততায়ীর হাতে সুলতান মালিক শাহের মৃত্যু হয়। সুলতানের বিধবা স্ত্রী তাঁকে ঘৃণার চোখে দেখেন। প্রকাশ্যেই সুলতানের মৃত্যুর জুন্য ওমরকে দায়ী করেন। সুলতানের স্ত্রীর সন্দেহ ছিল, খৈয়াম এ হত্যার পেছনে গুপ্তচর ছিলেন। এমন বেগতিক অবস্থায় ওমর খৈয়াম সব ছেড়ে হজ করতে যান। দীর্ঘ সময় ছিলেন সেখানে। একসময় তাঁকে নিশাপুরে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। নিশাপুরে ওমর গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিষয়ক তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলো সমাপ্ত করেন। বীজগণিতে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধানও প্রথম তাঁর হাতেই হয়। ৪ ডিসেম্বর ১১৩১ সালে ৮৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।