১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উত্তরাঞ্চলে ১৩ জন সৈন্যকে হত্যার মাধ্যমে শুরু করেছিল দেশটির রক্তাক্ত ইতিহাস। দীর্ঘ ২৬ বছর চলে এই গৃহযুদ্ধ। যার অবসান ঘটে ২০০৯ সালে। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে হওয়া গৃহযুদ্ধ শুধু শ্রীলঙ্কাতেই নয়, এর প্রভাব পড়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। এক সময় সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন বিশ্ব নেতারাও। বিদ্রোহী তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণের মৃত্যু যবনিকা টানে এই গৃহযুদ্ধের...
দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ
১৯৮৩ সালের জুলাই মাসকে শ্রীলঙ্কানরা বলে ব্ল্যাক জুলাই’ বা ‘কালো জুলাই’। সেই মাসের ২৩ তারিখ তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশটির উত্তরাঞ্চলে ১৩ জন সৈন্যকে হত্যা করে। এটাই ছিল তামিল টাইগারদের প্রথম আক্রমণ। আর এর মাধ্যমেই শ্রীলঙ্কার রক্তাক্ত ইতিহাসের শুরু। পরবর্তীতে সেই যুদ্ধ শ্রীলঙ্কা দ্বীপজুড়ে সংঘটিত হওয়া একটি সশস্ত্র সংঘাতে পরিণত হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীর করা আঘাতের প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায় পাল্টা হামলা চালায়। কিন্তু এই বিদ্রোহের মাধ্যমে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) দ্বীপের উত্তর ও পূর্ব অংশ নিয়ে তামিল ইলম নামে তামিল জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে দেশের জনসংখ্যা, পরিবেশ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ক্ষতির সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক হিসাব অনুসারে প্রায় ১ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটে। এর মধ্যে তামিল সম্প্রদায়ের প্রায় তিন হাজারেরও বেশি সদস্য ছিল। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় হাজার হাজার তামিল। সংঘর্ষের প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী এলটিটিই কর্তৃক দখলকৃত এলাকা পুনর্দখল করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে নেওয়া লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের কর্মপন্থার কারণে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশসহ ৩২টি দেশে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। শ্রীলঙ্কার সরকারি বাহিনীকেও মানবাধিকারের অপব্যবহার, নিয়মিত শাস্তি প্রদানের দ্বারা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, আটকদের প্রতি মানবিক সম্মান প্রদর্শনের অভাব এবং জোরপূর্বক অন্তর্ধান সম্পর্কিত অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতিতে দুই দশকের যুদ্ধ এবং শান্তি আলোচনার চারটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে এই সংঘর্ষের একটি স্থায়ী সফল নিষ্পত্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় এবং ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে ২০০৫ সালের শেষের দিকে সীমিত শান্তির অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটে। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে সরকার পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে এলটিটিইর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি প্রধান সামরিক অভিযান চালিয়ে সমগ্র পূর্বাঞ্চল থেকে এলটিটিইকে সরিয়ে দিতে থাকে। এলটিটিই তখন ঘোষণা করে যে তারা ‘নিজেদের জন্য একটি পৃথক রাজ্য অর্জনের জন্য তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম পুনরায় শুরু করবে’। তবে দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক অভিযান পরিচালনার পর শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী ২০০৯ সালের মে মাসে তামিল টাইগারদের পরাজিত করার মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়।
বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কার প্রথম রাজা (৫৪৩-৫০৫)
পালি ক্রনিকলস ও মহাবংশতে উল্লেখ পাওয়া যায়, শ্রীলঙ্কার রেকর্ডভুক্ত প্রথম রাজা ছিলেন রাজকুমার বিজয় সিংহ। তার রাজত্বের কাল ঐতিহ্যগতভাবে ৫৪৩-৫০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিংবদন্তি অনুযায়ী ভারতের সিংহপুর রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত হয়ে কয়েকশ অনুগামীসহ শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন। শ্রীলঙ্কায় তারা দ্বীপের মূল অধিবাসী যক্ষদের প্রতিষ্ঠিত রাজ্য জয় করে রাজত্ব করতে শুরু করে। পরে হয়ে ওঠে আধুনিক সিংহলি জাতির পূর্বপূরুষ। মগধের রাজা সিংহবাহুর ছেলে হওয়ায় বিজয় সিংহ রাজপুত্র হন। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে বিজয় ও তার অনুসারীরা হয়ে ওঠে কুখ্যাত। এ নিয়ে বিক্ষুব্ধ হন প্রজারা। তাদের দাবি অনুযায়ী বিজয়ের শাস্তি হবে মৃত্যু। তবে রাজা সিংহবাহু ৭০০ অনুগামীসহ বিজয়কে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করে। পুরুষদের মাথা অর্ধেক কামিয়ে একটি জাহাজে করে পাঠানো হয়েছিল সমুদ্রে। তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পাঠানো হয় পৃথক দুটি জাহাজে। এ যাত্রায় পুরুষরা অবতরণ করে সুপ্পারকাতে, নারীরা অবতরণ করে মহিলাদ্বীপে আর শিশুরা অবতরণ করে নাগাদ্বীপে। সবশেষে বিজয়ের জাহাজ পৌঁছায় শ্রীলঙ্কার তাম্রপাণিতে। একই দিনে গৌতম বুদ্ধ মারা যান উত্তর ভারতে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, আজকের সোপরা হলো সেই সুপ্পারাকা। মহাবংশ অনুযায়ী, স্বর্গে পৌঁছানোর পর গৌতম বুদ্ধ দেবরাজ ইন্দ্রকে অনুরোধ করেন বিজয়কে শ্রীলঙ্কা রক্ষার জন্য, যাতে সেখানে সে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করতে পারে। শ্রীলঙ্কায় এসে মন্ত্রিপরিষদ গঠন, নতুন গ্রাম তৈরি ও রাজ্য পরিচালনায় নিজস্ব নিয়মকানুন এনে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকে।
মাত্র ৮০ জন নিয়ে মালদ্বীপ দখল করেছিল শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার কিছু তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সৈন্য মালদ্বীপ দখলের পরিকল্পনা করেছিল। যার ফলে ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে একটি অভ্যুত্থান ঘটে। এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ৮০ জন সশস্ত্র সৈন্য। মাত্র অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে একটা দেশ দখল করে ফেলার নজির বিশ্বে আর একটাও নেই। তবে এর পেছনের মূল কারিগর ছিল স্থানীয় জনগণই। যার নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ লুথুফি। শ্রীলঙ্কান তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সাহায্য নেন আবদুল্লাহ লুথুফি। পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলম নামের শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি সুযোগ বুঝে হাত মেলান আবদুল্লাহ লুথুফির সঙ্গে। সংগঠনটির মাত্র কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য এই অভিযান পরিচালনা করেন। পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলম নামের শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংগঠনটির কূটনৈতিক কার্যক্রম ছিল ব্যাপক শক্তিশালী। মামুন আবদুল গাইয়ুম ছিলেন তৎকালীন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। তার বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ লুথুফি অভ্যুত্থান ঘটানোর উদ্দেশ্যে পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলমের সৈন্যদের ভাড়া করেন। বলা হয়ে থাকে, এই কাজের জন্য দলটিকে ১ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছিল। তবে অনেকে দাবি করেন অর্থের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। এমনকি এটা ১০ মিলিয়ন ডলারও হতে পারে। এর আগে ১৯৮০ এবং ১৯৮৩ সালেও দুটি অভ্যুত্থান হয়। তবে সে ক্ষেত্রে অভ্যুত্থানকারীরা বিফল হলেও শ্রীলঙ্কার পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সৈন্যরা ঠিকই সফল হয়েছিল। পানিপথে সৈন্যদল স্পিডবোটে করে মালদ্বীপে প্রবেশ করে। তারা খুব সহজেই রাজধানীসহ বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, এয়ারপোর্ট, টেলিভিশন এবং রেডিও স্টেশনের দখল নিয়ে নেয়। কিন্তু তারা মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করতে ব্যর্থ হয়। প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে থাকেন। এর মাঝে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ভারত সরকারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই ১৬০০ সৈন্যের একটি দল আকাশপথে মালদ্বীপ পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠান। ভারতীয় সৈন্যদল অপারেশন ক্যাকটাস নামে একটি সফল অভিযান চালিয়ে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা দক্ষতার সঙ্গে দেশটিকে দখলমুক্ত করে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুমকে উদ্ধার করে। পরে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম ১১ নভেম্বর ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। দেশটিতে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামেন। মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট সরকারপ্রধান হিসেবে ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন। প্রেসিডেন্ট নিজেই ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের প্রধান হিসেবে সব কর্মকা- পরিচালনা করেন। প্রেসিডেন্ট পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তবে মুসলিম অধ্যুষিত দেশটিতে অমুসলিমদের কোনো ভোটাধিকার নেই। মালদ্বীপে ৫০ সদস্যের একটি মজলিসে শূরা রয়েছে। এই শূরা সদস্যরাও পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই ৫০ সদস্যের মধ্যে আটজনকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করেন। এই একটি উপায়েই মহিলারা সংসদে প্রবেশের সুযোগ পান। দেশটিতে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম দলটি প্রতিষ্ঠিত করেন। দলের নাম ‘দ্য মালদ্বীপিয়ান পিপলস পার্টি’। একই বছর আরেকটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়। দলটির নাম ‘মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’। বর্তমানে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ইয়ামেন জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
তামিল টাইগারদের পরাজয়
২০০৭ সালে পূর্বাঞ্চলে তামিল টাইগারদের শক্ত ঘাঁটি দখল করে নেয় শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী। এর পরের বছরের শুরুতেই যুদ্ধবিরতি অকার্যকর ঘোষণা করে সরকার। তারপর বড় ধরনের যুদ্ধাভিযান শুরু করে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী। চলমান সে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে টাইগারদের ঘোষিত রাজধানী কিলোনাচ্চি দখল করে নেয় তারা। সামরিক বাহিনীর আগ্রাসী আক্রমণে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে তামিল টাইগাররা। তাদের আত্মসমর্পণের জন্য ২০ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার সাধারণ মানুষ যুদ্ধাঞ্চল থেকে পালিয়ে আসে। মে মাসের ১৬ তারিখ প্রথমবারের মতো সমগ্র উপকূলসীমার নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। সে সময় জর্ডান সফররত প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে দাবি করেন, এলটিটিই পরাজিত হয়েছে। তখন বেসামরিক নাগরিকের বেশ ধরে প্রচুর তামিল টাইগার সৈন্য নৌকা করে পালানোর সময় নিহত হয়। এ ছাড়া আরও অনেকে আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে প্রাণ বিসর্জন দেয়। সেই যুদ্ধ এলাকার সব বেসামরিক নাগরিককে মুক্ত করার ঘোষণা দেয় সেনাবাহিনী।
রাজীব গান্ধীর মৃত্যু
১৯৯১ সালের ২১ মে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যের শ্রীপেরামবুদুরে এক আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা রাজীব গান্ধী হত্যাকা- নামে পরিচিত। এই বিস্ফোরণে রাজীব ছাড়াও আরও ১৪ জন নিহত হয়েছিলেন। রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেন তেনমোঝি রাজারত্নম নামে লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম বা এলটিটিইর এক নারী সদস্য। এর দুই বছর পরে আরেকটি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা। দুটি হামলার জন্যই এলটিটিইকে দায়ী করা হয়। ১৯৯১ সালে চেন্নাইয়ের কাছে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার জন্য প্রভাকরণকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, আশির দশকের মাঝামাঝিতে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের প্রতিশোধ নিতে রাজীব গান্ধীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রভাকরণ। এর পরই ভারতের আদালত প্রভাকরণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সেই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ, খুন ও সংঘটিত নানা অপরাধের অভিযোগে ইন্টারপোলের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম ওঠে প্রভাকরণের। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন প্রভাকরণ। এর পরই ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসাকে হত্যা করা হয়।
তৃতীয় ইলম যুদ্ধ
১৯৯৫ সালে নৌবাহিনীর জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে বিদ্রোহীরা শুরু করে ‘তৃতীয় ইলম যুদ্ধ’। তবে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর কাছে জাফনার নিয়ন্ত্রণ হারায় তামিল টাইগাররা। তখন থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে চলতে থাকে গৃহযুদ্ধ। ১৯৯৬ সালে কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আত্মঘাতী বোমা হামলা থেকে শুরু করে অসংখ্য মেয়র, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে এলটিটিই বাহিনী। আর এভাবেই দেশের উত্তরাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল পরিচালনা শুরু করেন প্রভাকরণ। তৎকালীন কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয় প্রায় ১০০ জন। টাইগারদের হামলায় আরও আহত হন প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। অবশেষে ২০০২-এ নরওয়ের মধ্যস্থতায় সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর হয়। ২০০৪-২০০৫ সালে টাইগারদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার কর্নেল করুণা আমান প্রায় ছয় হাজার যোদ্ধা নিয়ে এলটিটিই থেকে বেরিয়ে যান। সন্দেহভাজন টাইগারদের হামলায় নিহত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামার। সে সময় কট্টর এলটিটিই বিরোধী মাহিন্দা রাজাপক্ষে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের এপ্রিল থেকে আবারও শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এতে বিশ্বনেতারা অক্টোবরে জেনেভায় নতুন করে আলোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
প্রভাকরণ নায়ক নাকি ভিলেন
প্রভাকরণকে ‘সূর্যদেবতা’ বলে ডাকত তার সমর্থকরা। অবশ্য তার বিরোধীরা তাকে অত্যন্ত নির্দয় বলেও অভিহিত করত। ইতিহাস বলছে, দেশের এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক নেতাদের হত্যার পেছনের কারিগর তিনি। একদিকে বীর যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে তার কুখ্যাতি। ইতিহাসের পাতায় এভাবেই লেখা হয়েছে প্রভাকরণের নাম। ভারতের আদালত থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল প্রভাকরণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তবে ইন্টারপোলের নথি থেকে জানা যায়, প্রভাকরণ এমন এক ব্যক্তি যিনি যে কোনো মুহূর্তে ছদ্মবেশ ধারণ করতে সক্ষম ছিলেন এবং আধুনিক সমরাস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। ১৯৫৪ সালের ২৬ নভেম্বর জাফনা উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থিত উপকূলীয় শহর ভেলভেত্তিয়াথুরাইতে জন্মগ্রহণ করেন প্রভাকরণ। মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ও নেপোলিয়ানসহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই প্রবাদ পুরুষ সুভাষচন্দ্র বসু এবং ভগত সিং দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন প্রভাকরণ।
লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম
১৯৭৩ মতান্তরে ১৯৭৪ সালে প্রভাকরণ ‘তামিল নিউ টাইগার্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম অবস্থায় এ সংগঠনটি তামিলদের প্রান্তিক নানা অবস্থার প্রতিবাদকারী একটি সংগঠনের মতো কাজ করলেও এক বছর পর এটি লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিই নামে প্রতিষ্ঠা পায়। এর পরই সংগঠনটির বিরুদ্ধে জাফনার মেয়রকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। তারপরই টাইগাররা ১০ হাজারেরও বেশি সদস্যের দুর্র্ধর্ষ বিশাল বাহিনীতে পরিণত হয়। স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় প্রভাকরণের সঙ্গে পুরুষদের পাশাপাশি বহু নারী ও শিশুও যোগ দেয়। বিশাল একটা অংশের নেতৃত্বের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন প্রভাকরণ। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমের নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তামিল টাইগার নামেই পরিচিতি পায় সংগঠনটি।
প্রভাকরণের মৃত্যু
শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো সেনারা লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রভাকরণকে হত্যা করে বলে দেশটির সেনাসূত্রগুলো এ দাবি করে। আরও বলা হয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টার সময় তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর সময় ৫৪ বছর বয়সী এই দুর্র্ধর্ষ গেরিলা নেতা অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি কখনই জীবিত অবস্থায় ধরা পড়বেন না। সেনাবাহিনীর একটি সূত্র উল্লেখ করে, আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স নিশ্চিত করে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে পালিয়ে যাওয়ার সময় প্রভাকরণকে হত্যা করা হয়। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এর আগেই প্রথমবারের মতো প্রভাকরণের ছেলে এবং অন্য শীর্ষ নেতাদের নিহত হওয়ার খবর ও ছবি প্রকাশ করে। এর একদিন আগেই শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী পুরো উপকূলীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এলটিটিইকে পরাজিত করার ঘোষণা করেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে।
যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা
২০০৯ সালে দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। উত্তরের তামিলরা ১৮ মে দিনটিকে নীরব গুমোট আবহাওয়ায় মৃত্যু দিবস হিসেবেই পালন করে। আর কলম্বোতে দিনটিকে বিবেচনা করা হয় বিজয় দিবস হিসেবে। সামরিক বাহিনী-সংশ্লিষ্ট অনেক অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে দিনটিতে। সেটা ছিল লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিইর শেষ দুর্গ। নন্দিকাদল খাড়ি আর বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে থাকা উত্তর-পূর্ব শ্রীলঙ্কার মুল্লিওয়াইক্কিল নামে ছোট্ট ভূখ-টি ছিল লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিইর শেষ দুর্গ। দারিদ্র্যপীড়িত এ অঞ্চলের মানুষগুলো মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে। অথচ এলাকাটি যুদ্ধ শেষের আট বছর পরও বিধ্বস্তই রয়ে গেছে। এখনো সেখানকার মানুষ বোমায় বিধ্বস্ত বাড়িগুলোতে বসবাস করছে। ভয়াবহ ওই গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত যেসব এলাকা রয়েছে এটি তার একটি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের আমলে তামিলদের দুর্দশার কাহিনী প্রকাশ্যে আসতে পারত না। সে সময় তাদের অবস্থা ছিল ভয়াবহ শোচনীয়। তবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার আমলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। তামিলদের শোচনীয় অবস্থার কথা গণমাধ্যমে উঠে আসছে।
তবে নর্দার্ন প্রভিন্সের মুখ্যমন্ত্রী সি ভি বিগনেশ্বরন এবার শোক দিবস পালনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যা আদালতের নির্দেশে সম্ভব হয়নি। এই মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি পাক বা না পাক, আন্তর্জাতিক তদন্ত হলে সত্যিকারের কাহিনী বের হয়ে আসবে। কথিত ‘বিশ্বাসযোগ্য’ ভাষ্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬-২০০৯ সালের গৃহযুদ্ধে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার উচিত ছিল যুদ্ধের পরপরই উভয় পক্ষের আস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের বিখ্যাত উক্তি ‘আর কোনো সংখ্যালঘু থাকবে না’ মন্তব্য করেছিলেন। এর রেশ ধরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত সহজেই। রাজাপক্ষে যদিও বিশাল বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু এসব প্রকল্প সিংহলি ও তামিলদের মধ্যকার ব্যবধান কমাতে খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।