সোমবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
দেউলিয়া ঘোষিত ব্যবসাকে করেন বিশ্বের শীর্ষ বিলাস পণ্যের কোম্পানি

যেভাবে শীর্ষ ধনী বার্নার্ড আর্নল্ট

► সম্পদ ১৯ লাখ কোটি টাকারও বেশি ► বিলাসবহুল ফ্যাশন পণ্যের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডের মালিক তিনি

তানভীর আহমেদ

যেভাবে শীর্ষ ধনী বার্নার্ড আর্নল্ট

বার্নার্ড আর্নল্ট এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। বয়স ৭৩ বছর। বিল গেটস কিংবা ইলন মাস্কের মতো আলোচনায় না থাকায় তার নাম খুব একটা শোনা হয়নি অনেকের। কিন্তু বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের দলে তিনি গত দুই দশকে সব সময় ছিলেন। ফ্রান্সের এই ধনকুবের ব্যবসায়ীর জন্ম ১৯৪৯ সালে। পারিবারিকভাবেই তিনি ধনী ছিলেন। তার নানার কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা ছিল। বার্নার্ড আর্নল্টের বাবা বিয়ের পর শ্বশুরের কাছ থেকে সেই ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব পান। ফেরেট স্যাভিনেল নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা ছিল বার্নার্ডের পারিবারিক ব্যবসা। আর্নল্ট ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায় ওই ব্যবসাতেই যোগ দেন তিনি। ব্যবসায়ী হিসেবে বার্নার্ড যে দূরদর্শী তার প্রমাণ পাওয়া যায় তখনই। কারণ হুট করেই পারিবারিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসাকে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় বদলে নেন তিনি। ১৯৮১ সালের দিকে তিনি চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে এসে শুরু করেন আবাসন ব্যবসা। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যবসায়ী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় আধিপত্য করছেন। আর্নল্ট তার ব্যবসা ইউরোপে সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিলেন। তাই তিন বছর পর ফিরে আসেন নিজ দেশ ফ্রান্সে। ফ্রান্স ফ্যাশনের রাজধানী। গোটা বিশ্বের ফ্যাশন ট্রেন্ড ফ্রান্সের প্যারিসকে ঘিরে ঘোরপাক খায়। দামি সুগন্ধি, ওয়াইন ও পোশাক ব্যবসায় সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি ফ্রান্সে ফিরে এসে তার নজরে পড়ে বুজ্যাঁক সঁ ফ্রেরেস। বহুজাতিক বস্ত্র সংস্থাটির অবস্থা তখন শোচনীয়। ফ্রান্সে নিজেদের দেউলিয়া করেছে বুজ্যাঁক সঁ ফ্রেরেস। তাদেরই একটি অংশ ছিল ক্রিশ্চিয়ান ডয়ের। মাত্র তিন বছরের মধ্যে এই কোম্পানি পুরোটাই নিজের করে নেন আর্নল্ট। এখন বিশ্বের শীর্ষ ফ্যাশন কোম্পানির একটি এই ডয়ের। এই ডয়েরের জন্যই বুজ্যাঁক কিনতে আগ্রহী হন বার্নার্ড। এ ছাড়া বার্নার্ডের মায়ের পছন্দের ব্র্যান্ড ছিল ডয়ের। বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ড কিনে সেই ব্র্যান্ডের হয়েই ওই সংস্থাটি নিলামে কিনে নেন তিনি। বুজ্যাঁক তার হাতে আসার পর তিনি কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিলেন। একসঙ্গে প্রায় ৯ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করে দেন তিনি। ডয়ের এবং একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছাড়া বুজ্যাঁকের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেন বার্নার্ড।  এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনা শুরু হয় তাকে নিয়ে। তবে ব্যবসা লাভে এনে সব সমালোচনার জবাব দেন তিনি। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করে ডয়ের।

 

শেয়ার কিনে শুরু, শেষে পুরো ব্যবসা দখল

শেয়ার কিনে পুরো ব্যবসা নিজের করে নেওয়ার কৌশল বার্নার্ড আর্নল্ট কাজে লাগাতে শুরু করেন। বর্তমান বিশ্বে ফ্যাশন ব্র্যান্ড লুই ভিতোঁকে কে না চেনে? তার পুরো নাম মোয়েথ এনেসি লুই ভিতোঁ। এই ব্যবসাটির ছিল দুটি সংস্থা- লুই ভিতোঁ এবং মোয়েথ এনেসি। দুই সংস্থার প্রধানের সঙ্গে কথা বলে একটি বিলাসদ্রব্যের বড় ব্র্যান্ড তৈরির করার পরিকল্পনা করেন বার্নার্ড। তখন লুই ভিতোঁর প্রধান ছিলেন হেনরি রিক্যামিয়ার। মোয়েথ এনেসি এবং লুই ভিতোঁ একসঙ্গে একটি ব্র্যান্ড হওয়ার পর বার্নার্ড ধীরে ধীরে শেয়ার কিনতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত পুরনো প্রধান রিক্যামিয়ারকে সরিয়ে নিজে বসেন তার জায়গায়। এ ঘটনার পর বার্নার্ডের পরিচিতি ফ্রান্স তো বটেই ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা বলতে শুরু করেন, বার্নার্ড কোনো সংস্থার শেয়ার কিনতে শুরু করেছেন মানে সেই সংস্থার দখল করেই ছাড়বেন তিনি। একই কৌশলে একের পর এক ব্র্যান্ডের দখল করতে পারলেও বার্নার্ড ধাক্কা খান জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘গুচি’ কিনতে গিয়ে। শুরুতেই সতর্ক হয়ে বার্নার্ডকে রুখে দেয় গুচি।  যদিও সহজে ছাড়েননি বার্নার্ডও। ফলে আইনি লড়াই শুরু হয়। শেষে কোর্টের নির্দেশে হাল ছাড়তে হয় বার্নার্ডকেই।

 

যে কারণে তার ডাকনাম টার্মিনেটর

হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমার চরিত্র টার্মিনেটর। আর্নল শোয়ার্জনেগার টার্মিনেটর চরিত্রে অভিনয় করে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পান। সেই সিনেমার চরিত্রের নামটা কপালে জুটেছে বিশ্বের শীর্ষ ধনী বার্নার্ড আর্নল্টের। নামটি দিয়েছে তার কোম্পানির কর্মীরা। পরে মুখে মুখে সে নাম জায়গা করে নিয়েছে মিডিয়াতেও। কর্মী ছাঁটাই বা টার্মিনেট করেন বলেই তাকে এ নাম দেওয়া হয়েছে। বার্নার্ড আর্নল্টের ব্যবসায়িক কৌশলের একটি নতুন ব্যবসা নিজের নামে করে নিতে পারলেই সেখানকার পুরনো কর্মীদের ছাঁটাই শুরু করেন তিনি।  এই ছাঁটাই আবার ছোটখাটো পরিসরে করেন না। কিছু ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়ে শুরু করেন কর্মী ছাঁটাই। বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ড বুজ্যাঁক তার হাতে আসার পর তিনি একসঙ্গে প্রায় ৯ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করে দেন। শিল্পমহলে তিনি ‘টার্মিনেটর’ নামে কুখ্যাতি পান।

 

তার হাতের মুঠোয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সাম্রাজ্য

৩০ বছরে বার্নার্ড আর্নল্টের হাত ধরে ইউরোপে বিলাসবহুল পণ্যের ভরসাস্থলে পরিণত হয় এলভিএমএইচ বা মোয়েত এনেসি লুই ভিতোঁ। শেম্পেইন, ওয়াইন, ফ্যাশনেবল পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ঘড়ি, গহনা, পারফিউম ও কসমেটিক পণ্যের এক বিরাট হাব এলভিএমএইচ। শুধু ফ্রান্স না সমগ্র ইউরোপে এলভিএমএইচ এখন বিলাসবহুল পণ্য বিক্রির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। লুই ভিতোঁর ব্যাগ থেকে ক্রিশ্চিয়ান ডয়েরের সুগন্ধী, হাবলটের ঘড়ি থেকে লে পার্সিয়ানের মতো প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে সারা বিশ্বে এলভিএমএইচের সাড়ে ৫ হাজার স্টোর রয়েছে। শুধু ইউরোপ নয় নব্বই দশকের শেষে বেইজিং এ লুই ভিতোঁ দোকান খুলেছেন চীনে। ফ্যাশন জগতে লুই ভিতোঁ কতটা জনপ্রিয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রথম সারির সেলিব্রেটিদের দিকে তাকালে। নিশ্চয়ই মনে আছে, প্যারিসে আয়োজিত ফ্যাশন সপ্তাহের রেড কার্পেটে  হেঁটেছিলেন বলিউডের অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। সেদিন তিনি পড়েছিলেন ‘লুই ভিতোঁ’-এর পোশাক। হাতে ছিল এই ব্র্যান্ডেরই হাতব্যাগ। ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্য ডায়ানার হাতেও দেখা গেছে লুই ভিতোঁর ব্যাগ। কেট মিডলটন এবং মেগান মর্কেলকেও প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায় বার্নার্ডের সংস্থার তৈরি বিলাসদ্রব্য। লুই ভিতোঁর মতই আন্তর্জাতিক নামিদামি বহু ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মালিক বার্নার্ড আর্নল্ট। এর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান ডয়ের, ফেন্দি, জিঁভসি, মার্ক জেকবস, স্টেলা, ম্যাককার্টনি, ট্যাগ হোইয়র, বুলগরি, টিফনি অ্যান্ড কোর মতো সংস্থা রয়েছে।  এমন মোট ৭৫টি সংস্থার মালিকানা এখন বার্নার্ডের হাতে।

 

কত সম্পদ তার

বার্নার্ড আর্নল্ট আন্তর্জাতিক মানের বিলাসবহুল এবং ফ্যাশন-দ্রব্যের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড ‘মোয়েত এনেসি লুই ভিতোঁ’(এলভিএমএইচ)-এর চেয়ারম্যান এবং সিইও। ধনী তালিকায় বার্নার্ড এবং তার পরিবারের মোট সম্পত্তিকেই প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। বার্নার্ড এবং তার পরিবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ এখন ১৭৯.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে শুধু বার্নার্ডের সম্পত্তি ১৭ হাজার ১০০ কোটি ডলার। করোনা থেকে যুদ্ধাক্রান্ত সময়ে অন্য সব বিলিয়নিয়ারের মতো বার্নার্ডেরও সম্পত্তির পরিমাণ কমেছে। চলতি বছর এ ধনকুবেরের সম্পত্তির পরিমাণ কমেছে ৭.২ বিলিয়ন ডলার। যদিও করোনার সময়েও এলভিএমএইচের পণ্য বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬৮ বিলিয়ন ডলার- যা চলমান ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে বার্নার্ড ও তার পরিবার কোম্পানিটির ৪৮ শতাংশ শেয়ারের মালিক। বর্তমানে এলভিএমএইচ কোম্পানির অর্থমূল্য ৩৬৪ বিলিয়ন ইউরো, যা পুরো ইউরোপে সর্বোচ্চ।

 

ব্যক্তিগত বিমান বিক্রি করে আলোচনায়

বরাবরই ক্যামেরার আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন তিনি। যখন শীর্ষ ধনী হলেন অনেকেই হুট করে তাকে চিনতে পারেননি। কোথাও ঘুরতে গেলেও ক্যামেরা পিছু ছাড়তে চায় না তার। এ কারণে নিজের প্রাইভেট বিমানটি বিক্রি করে দেন তিনি। তবে এর পেছনের কারণটির আলোচিত। বিগত কয়েক বছর ধরে বিলিয়নিয়াররা কার্বন নিঃসরণের জন্য বারবার অভিযুক্ত হতে থাকায় বার্নার্ড আর্নল্ট তার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত জেট বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানায় গণমাধ্যমগুলো। ব্যক্তিজীবনে বার্নার্ড আর্নল্ট দুবার বিয়ে করেছেন এবং ৫ সন্তানের পিতা। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে এখনো রয়েছেন তিনি। তার ছেলেমেয়েরাও যোগ দিয়েছেন তারই সংস্থায়। তার দ্বিতীয় সন্তান এন্টোনি ক্রিশ্চিয়ান ডয়েরের দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই অবসর সময়ে টেনিস খেলে সময় কাটান এ বিলিয়নিয়ার। বর্তমানে বার্নার্ডের বয়স ৭৩ বছর হলেও  নিজের কোম্পানিটিতে বিশেষ ক্ষমতাবলে ৮০ বছর পর্যন্ত প্রধান  নির্বাহীর দায়িত্বে থাকতে পারবেন এ ধনকুবের।

সর্বশেষ খবর