এই পাড়ার পুকুরটায় বাস করে পাঁচ থেকে সাত বংশের ব্যাঙ। ন্যাঙর, ম্যাঙর, ল্যাঙর, ক্যাঙর, প্যাঙর, হ্যাঙর, ট্যাঙর বংশের ব্যাঙ। তবে তাদের সবচেয়ে উঁচু বংশ হলো ট্যাঙর বংশ। এ পুকুরে হিংকি ব্যাঙের বংশ হলো ট্যাঙর বংশ। তাই হিংকি ট্যাঙর ব্যাঙই এ পুকুরের সরদার। তিনি এ পুকুরের বিচার-আচার করেন। কোনো সমস্যা হলে ছুটে আসে অন্য ব্যাঙরা সরদার হিংকি ট্যাঙরের কাছে। তিনি তার সমাধান দেন। ব্যাঙ সরদার হিংকি ট্যাঙরের কথার ওপর কথা বলা কার সাধ্য আছে? এ পুকুরটাই যেন ছোটখাটো একটা রাজ্য। যার রাজা ব্যাঙ হিংকি ট্যাঙর।
শাপলা ও পদ্মফুল ভর্তি পুকুরজুড়ে। সেখানেই থাকে সব ব্যাঙের বংশধর। আর আছে পুকুরপাড়ে কচুপাতার গাছ। আছে লতাপাতা। সে কচুপাতা লতাপাতাতেও থাকে ব্যাঙ তাদের পরিবার নিয়ে। ব্যাঙের ছানারা তিড়িংবিড়িং করে লাফালাফি করে। পদ্মফুলের সবুজ পাতার ওপর। গিয়ে বসে শাপলা ফুলের ওপর। আবার ঝাপ দেয় পুকুরের পানিতে। দেয় ডিগবাজি। খেলে ছোটাছুটির খেলা। তবে পুকুরের মাঝখানে যে পদ্মফুল ফুটে আছে একগুচ্ছ বড় বড় পাতা মেলে। সেখানে থাকে ব্যাঙ সরদার হিংকি ট্যাঙরের পরিবার। পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান। পদ্মফুলের সবুজ পাতায় পাতায় চলে সরদার হিংকি ট্যাঙরের একমাত্র ছেলে নিংকি ট্যাঙরের চলাফেরা।
ছেলের বয়স হয়েছে। বিয়ে করাবেন বাবা হিংকি ট্যাঙর। ঘটক টিকটিকির কাছে ভালো কনের খোঁজ চান হিংকি সরদার। যেমনতেমন কনে হলে চলবে না। সরদারের একমাত্র ছেলের বউ হতে হবে রূপেগুণে সবার সেরা। বংশ হতে হবে উঁচু। হেনতেন বংশ হলে হবে না।
ঘটক টিকটিকি কিছুদিনের মধ্যে টুপি মাথায় বগলে ছাতা নিয়ে হাজির সরদার বাড়ি। এমন কনের সন্ধান এনেছি গো সরদার, কনে মাশাআল্লাহ একখান। যেমন তার রূপ, তেমন গুণের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। সরদার ঘটক টিকটিকির কথা শুনে বলেন,
তা, বাড়ি কোথায়, কী বা বংশ, বাবার কী নাম?
বাড়ি ওই দক্ষিণ পাড়ার জলাশয়ে। বলল ঘটক টিকটিকি। উঁচু বংশ। ব্যাঙ ঢ্যাঙারের একমাত্র মেয়ে সুঙারি সুন্দরী।
ঘটক টিকটিকির কথা শুনে কনে দেখতে গেলেন সরদার হিংকি ট্যাঙর। দক্ষিণ পাড়ার জলাশয়ে। ঢ্যাঙারের বাড়িতে। সরদার হিংকি ট্যাঙর সব দেখে পছন্দ করলেন। নাহ, ঘটক টিকটিকি মন্দ বলেনি। কনে সুঙারি সুন্দরী দেখতে মাশাআল্লাহ। ভালো বংশের মেয়ে। তাই বিয়ের দিন-তারিখ পাকা করে এলেন সরদার। বিয়ে আগামী শুক্রবার।
সরদারের একমাত্র ছেলের বিয়ে। চারদিক হইহই রইরই কলরব। বিশাল পুকুর সেজে উঠেছে বিয়ে উপলক্ষে। পুকুরের চার কোণ সাজানো হয়েছে ব্যাঙের ছাতা দিয়ে। পদ্মফুলের সবুজ পাতা ও শাপলা ফুলের কলিতে পুকুর যেন ফুলের রাজ্য। পুকুর লাইটিং দিয়ে সুসজ্জিত করতে ভাড়া করেছে হাজার পাঁচেক জোনাকি। সেই জোনাকি পুরো পুকুর ঘেরাও দিয়ে আছে। মাঝ পুকুরে সরদার বাড়িতেও জোনাকির সয়লাব। সন্ধ্যে হলে সন্ধ্যা তারার মতো মিটিমিটি আলো দেয় জোনাকিরা। যত রাত হয় দূর থেকে দেখতে যেন এক টুকরো চাঁদ নেমে এসেছে এ পুকুরে।
পুকুর তো সাজানো শেষ। এবার দাওয়াতের কার্ড পাঠানো হলো বাড়িতে বাড়িতে। কাঁকড়া থেকে মৌমাছি। মশা-মাছি থেকে ঘাসফড়িঙ। ইঁদুর থেকে পিপীলিকা; সবার বাড়িতে বাড়িতে পাঠানো হলো কার্ড। ভোজ উৎসব হবে। ব্যাঙের ছাতার নিচে। আরও হবে কচুপাতার নিচে। সরদারের একমাত্র ছেলের বিয়ে! উৎসবটা জাঁকজমক না হলে চলে?
আসলো শুক্রবার। গত রাত থেকে গুড়ুক গুড়ুম মেঘের ডাক। সেই সকাল থেকে ঝুমঝুম বৃষ্টি। ব্যাঙের বিয়েতে বৃষ্টি না হলে হয়? বৃষ্টি পড়ছে থেমে থেমে। ব্যস্ত পুরো পুকুর। ব্যাঙরা গান ধরেছে। ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ স্বরে গান গাইছে। কেউ গাইছে বিয়ের গীত। পদ্মফুলের সবুজ পাতায় পাতায় নৃত্য করছে ব্যাঙ, কাঁকড়া, ঘাসফড়িয়ের দল।। ঝিঁঝিঁরা-ও মিহি স্বরে গুণগুণ করছে। পুকুরপাড় ঘেঁষা স্থলে ১০০ ডেক বসানো হলো উনুনে। সেরা বাবুর্চি দিয়ে চলছে রান্নাবান্না।
বরযাত্রী যাওয়ার সময় হয়েছে। বাহন হিসেবে ভাড়া করা হলো বড় বড় কচ্ছপ। ১০টি কচ্ছপ নিয়ে চলল বরযাত্রী। সবার আগে বিয়ের ব্যান্ড পার্টি বাজাচ্ছে কিছু ইঁদুর। তারপর প্রথম কচ্ছপের ওপর সরদার এবং ঘটক টিকটিকির আসন।
দ্বিতীয় কচ্ছপে বর নিংকি ট্যাঙর। মাথায় বিয়ের টুপি। গলায় মালা। হাতে রুমাল। সঙ্গে থাকা ঘাসফড়িং কচুপাতার ছাতা মেলে ধরেছে বর নিংকি ট্যাঙরের মাথার ওপর। আর বিয়ের টলি হাতে বন্ধু কাঁকড়া। এরপর আরও ৮টা কচ্ছপে চড়ে চলেছে বরযাত্রী। ব্যাঙ, কাঁকড়া, মৌমাছি, ফড়িং, পিপীলিকা, ইঁদুর, ঘাসফড়িং, মাছি, মশাসহ ইত্যাদি প্রজাতির কীটপতঙ্গ। এক লাইন ধরে চলছে সরদার হিংকি ট্যাঙরের একমাত্র ছেলে নিংকি ট্যাঙরের বরযাত্রী। বড় উৎসবের দিন আজ। এ বিশাল বরযাত্রী দেখতে এই পাড়া ওই পাড়া থেকে হাজারো কীটপতঙ্গের ভিড়। দূরদূরান্তর জলাশয় থেকে হিংকি ট্যাঙরের বরযাত্রী দেখতে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ। ছারপোকা, মাকড়শার ভিড় রাস্তার দুই পাশে উপচে পড়ছে। তাদের উৎসুক নয়ন দেখেনি এমন জমকালো বিয়ের বরযাত্রী। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই কেউ দেখছে এমন দৃশ্য। কেউ আবার কচুপাতার ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে। কেউ দিচ্ছে করতালি। দিচ্ছে কেউ শিস। কেউ গলা ছেড়ে ছড়া কাটছে...
‘ঢ্যাং ঢ্যাং
নিংকি ট্যাঙর ব্যাঙ
দক্ষিণ পাড়ার গাঁয়
বউ আনতে যায়।’