সিদ্ধান্ত ছিল, প্রস্তাবিত ছয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জমার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপ হবে; তবে সে সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন বলছে, সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার আগেই আরেক দফা সংলাপ হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ বিষয়টি জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফেরার পর এই প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এবং অপূর্ব জাহাঙ্গীর উপস্থিত ছিলেন।
সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, কালকে থেকে (১ অক্টোবর) কাজ শুরুর কথা; কিন্তু একটি সিদ্ধান্ত এসেছে, তার আগে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আরেক দফা আলোচনা করতে চায়। আলোচনা করে তাঁরা এটা (সংস্কার) চূড়ান্ত করবেন। বিষয়টি স্পষ্ট করতে বললে শফিকুল আলম বলেন, সংস্কারের জন্য ছয়জন কমিশন প্রধানের নাম দেওয়া হয়েছে। আমি বলতে পারি যে, কমিশনের কাজ কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তো এই সংস্কারের স্টেকহোল্ডার। সে কারণে সংস্কারের আগে তাদের সঙ্গে এই আলাপটা হবে, তাদের মতামত চাওয়া হবে। এ ছাড়া সংবিধান নিয়ে একটি কমিশন বা নির্বাচন নিয়ে যে কমিশন এগুলো করতে তো সময় লাগবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে নির্বাচনি টাইমফ্রেম নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে প্রেস সচিব বলেন, বিশ্বনেতারা নির্বাচনের টাইমফ্রেম নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। তারা যেটি করেছেন ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। তারা জানেন, এই সরকার যে ধরনের (সংস্কার) কাজ করছে তাতে সময় লাগবে।
‘১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া’ নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধানের একটি বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি অন্তর্বর্তী সরকার ধারণ করে কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, আমার মনে হয়, সেনাপ্রধান এখানে ‘ওপিনিয়ন’ দিয়েছিলেন। এটা ‘কোট-আনকোট’ ছিল না। রয়টার্সে যে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়েছে তার ৬ নম্বর প্যারায় বলা হয়েছে, সংস্কার সম্পন্ন করার পর ১৮ মাস। তো সে জায়গায় এটা ষোলো মাস, না আঠারো মাস, না বারো মাস, না ছয় মাস- এটা আসলে নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ। এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব আরও বলেন, যে কমিশনগুলো করা হলো, এটি খুব বড় একটা রাষ্ট্র মেরামতের কাজ। এই কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে পলিটিক্যাল কনসালটেশন এবং এই কনসালটেশনের পর বাংলাদেশের জনগণ, বাংলাদেশের সোসাইটি, দেশের সব স্টেকহোল্ডার যখন সিদ্ধান্ত নেবে যে, আমরা এই (নির্বাচন অনুষ্ঠান) বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছি, তখন নির্বাচন হবে। এটা কবে হবে এখনি নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলে নিউইয়র্কে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সে সম্পর্কে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এক কথার মানুষ। তিনি যদি বলে থাকেন নির্বাচনে অংশ নেবেন না, তো সেটিই করবেন। প্রধান উপদেষ্টা ভাবছেন যে রাষ্ট্র মেরামতের যে কাজ, এটি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। তিনি এই মহৎ কাজটি করতে চান। ব্রিফিংয়ের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব দাবি করেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধান উপদেষ্টার এ সফর ছিল ঐতিহাসিক এবং অতন্ত সফল।
এ সময় এক সাংবাদিক জানতে চান, কী কারণে এই সফরটিকে ‘সফল’ হিসেবে দাবি করা হচ্ছে? জবাবে শফিকুল আলম বলেন, আপনি যদি গত ২০, ৩০, ৪০ বছরের বাংলাদেশের লিডারদের জাতিসংঘে সফর দেখেন, সেখানে খুবই কম আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পেরেছেন। দু-তিনজন জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছেন। এবার যেটা হয়েছে যে, প্রফেসর ইউনূস চার দিনে প্রায় ৫০টি মিটিং করেছেন। এর মধ্যে ১২টি মিটিং ছিল বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে, যার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ইতালির প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, ডাচ প্রধানমন্ত্রী, মার্কিন ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও জাতিসংঘের মহাসচিব, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএলওর প্রধান রয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা বের হচ্ছেন আর একজন করে বিশ্বের শীর্ষ নেতা তাকে জড়িয়ে ধরছেন। প্রধান উপদেষ্টাকে সেখানে একজন ‘রকস্টার’-এর মতো অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। সবাই তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। এটি ঐতিহাসিক ছিল, কারণ এই সফরে সব নেতাই ড. ইউনূস সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তার সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করতে ইচ্ছুক।
জাতিসংঘ সফরে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে প্রেস সচিব জানান, বিশ্বব্যাংক ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দেবে। রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯ মিলিয়ন ডলার দেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তিতে ৪০০ মিলিয়ন ইউরো দেবেন। এ ছাড়া আইমএফের চিফ জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে আছেন। এরই মধ্যে সংস্থাটির একটি টিম বাংলাদেশ সফর করছেন। আইএমএফের এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা ফিরে গিয়ে বোর্ডকে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয়তা জানাবেন। সেই আলোকে সংস্থাটি অতিরিক্ত অর্থ সহায়তা দেবে। এটি গত বছরের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত সহায়তা হিসেবে আসবে। আমরা আশা করছি, অন্ততপক্ষে আরও ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে আইএমএফ। ব্রিফিংয়ের পর চাকরিপ্রার্থীদের বয়সসীমা ৩৫ করার আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, এই আন্দোলনটা নতুন নয়, প্রায় ১০-১৫ বছর ধরে হচ্ছে। আমরা মনে করি, নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন করবেন। এ ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন সংস্কারে যে কমিশন হয়েছে, আবদুল মুয়িদ চৌধুরী, তাঁর সঙ্গে তারা (আন্দোলকারীরা) বসতে পারেন। কারণ, তিনিই একটি ফুল প্যাকেজ নেবেন।