প্রশাসনের দুর্বলতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্যান্য উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ শেষে এ কথা জানান তিনি।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের অসন্তুষ্টিসহ দুর্গাপূজার নিরাপত্তার বিষয়ে কথা হয়েছে। শ্রমিকদের পাওনার ব্যাপারে সরকারকে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছি। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে সেজন্য সংস্কার দরকার বলে সরকারকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসনের দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে নির্ভর করছে মন্তব্য করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের জন্য একটি কাঠামো তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হলে সরকার একমত হয়েছে। সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে আমরা বলেছি, সংস্কার আমাদের (রাজনৈতিক দল)। আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না, সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি, যাতে নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়ায় একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করা যায়। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, সে কারণে সংস্কার প্রয়োজন। প্রথম থেকে সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বলে আসার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতা আমরা করব। আমরা প্রশাসনের কিছু দুর্বলতা দেখছি, সীমাবদ্ধতা দেখছি। সিভিল পুলিশসহ প্রশাসনে এমন কিছু দেখছি, যা উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো। মান্না বলেন, সংস্কারের একটা শর্তই হলো, সবাই সেটা গ্রহণ করবে। ন্যূনতম ঐক্যের প্রচেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়ে আমরাসহ সব রাজনৈতিক দল সরকারকে সহযোগিতা করব। তিনি বলেন, আমরা বলেছি, যতদূর পর্যন্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংস্কার করতে পারব, ততদূর পর্যন্ত আমরা সংস্কার করব। বাকি যেসব সংস্কার দরকার, তা পরের নির্বাচিত সরকার এসে করবে। প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সম্মান সফল নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের যদি মনে হয়, এই সরকারের লিপ্সা আছে, যদি মনে হয় অতীতের মতো ন্যায়-অন্যায় বাছবে না, অর্থের ধান্দা করবে, যদি দুর্নীতি বেড়ে যায়, তা আপনাদের ওপর বর্তাবে।
গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। একটা কাঠামো তৈরি করা দরকার। জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল হতে পারে। যেখানে অংশীজনরা বসবেন।’ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের বাজারে ঊর্ধ্বগতির ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি। পুরোনো সিন্ডিকেট আবার যে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছি। তারা বলেছেন, চারটা কাজকে অগ্রাধিকারের মধ্যে নিয়েছেন। সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। আমরা দেখতে চাই, মানুষ যেন এর সুফল পায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যাতে বন্ধ হয়।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপের সময় উপস্থিত ছিল গণতন্ত্র মঞ্চের ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল। তাদের নেতৃত্ব দেন মাহমুদুর রহমান মান্না। প্রতিনিধি দলে সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকি ছাড়াও ছিলেন ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা আকবর খান, আবুল হাসান রুবেল, আবু ইউসুফ সেলিম ও ইমরান ইমন।
খুনিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ সাত দফা : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাইয়ের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। সংলাপে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং খুনিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার দাবিসহ সাত দফা সংস্কার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানানো হয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানি, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম ও সহকারী মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ। ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, সংস্কার করতে যতটুকু সময় লাগে সংস্কার কাজ শেষ করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বৈরাচারীরা যেন কোনভোবে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে না পারে সে ব্যবস্থা করে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টাকে বলা হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনমতের প্রতিফলনের সরকার। আপনাদের সঙ্গে দেশের জনগণ রয়েছে, আপনারা সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার। কিন্তু খুনি, অর্থ পাচারকারী, দাগি, অপরাধীরা কীভাবে দেশ থেকে পালাল? আপনারা কেন তাদের দেশত্যাগের সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি বলেন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাদ দিয়ে আরপিও পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। ইসি নিয়োগে সাবেক বিচারপতি, আমলা ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে উলামায়ে কেরামকে সম্পৃক্ত করা। সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে ইসি নিয়োগ দেওয়া। ইসির কার্যক্রম জবাবদিহির আওতায় আনা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতায় মোতায়েন রাখা।
দুর্গম না হলে ব্যালট পেপার সকালে পাঠানো। সম্পদ পাচারকারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে যে কোনো নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। পুলিশ সংক্রান্ত উপনিবেশন আমলের সব আইন বাতিল করা এবং পুলিশের ব্রিটিশ লিগ্যাসি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস, চরিত্র বিবেচনা করে সেবা জনসহায়ক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা। অজ্ঞাত সংখ্যায় আসামি দিয়ে মামলা করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। আইনের উৎস হিসেবে শরিয়াহকে গ্রহণ করা। উচ্চ আদালতে আলাদা শরিয়া বেঞ্চ গঠন করা। বিচারপ্রার্থীর শরিয়া আইনে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ রাখাসহ অনেক বিষয় লিখিতভাবে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।