পাহাড় ছিল রাঙামাটি-২৯৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। টেন্ডারবাজি, ভর্তি ও নিয়োগবাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। শুধু তাই নয়, রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ ও বাজার ফ্রন্টের জমি এবং পাহাড় দখল চলত তার ছত্রছায়ায়। দলীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিল বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি পৌরসভা, এলজিডি, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, গণপূর্ত, পর্যটন, সড়কের টোল, ফরেস্ট, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ও পাবলিক হেলথসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিণত হয় তার বাণিজ্যিক কেন্দ্রে। পক্ষান্তরে জিম্মি ছিলেন সাধারণ মানুষ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব দুর্নীতির খোলস খুলতে শুরু করেছে পাহাড়ে। তার এসব দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে পার্বত্যাঞ্চল অর্থাৎ রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ছিল দলীয় নেতাদের দখলে। তাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন। চলত নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও অন্যায়। তার ক্ষমতার সামনে অসহায় ছিলেন বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। রাঙামাটি জেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মো. সাইফুল ইসলাম ভুট্টো অভিযোগ করে বলেন, রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক এমপি দীপংকরের দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। এমনকি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির (ওটিএম) মাধ্যমে লোপাট হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে ২০০ কোটি, জেলা পরিষদে ৪০০ কোটি, পাবলিক হেলথে ১০০ কোটি, এলজিডিতে ২০০ কোটি এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগে ১০০ কোটি টাকার ওটিএম টেন্ডারের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাশীন দলের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাভোকেট মো. মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, ক্ষমতায় থেকে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা কি-না করেনি। সবখানে তাদের দুর্নীতিতে টইটম্বুর ছিল। দখলে ছিল তাদের স্বর্গরাজ্য। শহরের মানিকছড়ি এলাকায় বিএনপির অফিস দখল করে নিজেদের দলীয় কার্যালয় বানিয়েছেন। রাঙামাটি শহরের ফিসারি বাঁধ এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের জমি দখল করে বানিয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা কার্যালয়। শুধু তাই নয়, রাঙামাটির ১০টি উপজেলাও বাদ পড়েনি। ভূমি দখল, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য ও নিয়োগবাণিজ্য ছিল তাদের অবৈধ টাকার উৎস। সাধারণ মানুষ ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে জিম্মি। পৌরসভার দুর্নীতির কারণে সাধারণ নাগরিকরা ছিলেন সুবিধাবঞ্চিত। এসব ঘটনায় দুর্নীতির মামলা হলেও ক্ষমতার দাপটে কার্যকর হয়নি। রাঙামাটিতে ঘরে ঘরে সাধারণ শিক্ষিত ছেলেমেয়ে বেকার। কারণ টাকা কিংবা ঘুষ ছাড়া চাকরি পাওয়া অসম্ভব ছিল। এসব ঘুষবাণিজ্যে লিপ্ত ছিল ছোট থেকে শীর্ষ নেতারাও। প্রকাশে ঘুষের লেনদেন চললেও মুখ খুলতে পারতেন না কেউ। প্রতিবাদ করলে হামলা-মামলা হয়রানির শিকার হতেন। দুর্নীতির কারণে রাঙামাটির বিভিন্ন সড়ক, সেতু ও কালভার্টের বেহাল দশা। শোচনীয় অবস্থা রাঙামাটি জেলার জেনারেল হাসপাতালও। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির কারণে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন রাঙামাটির সাধারণ মানুষ। এসবই হতো সাবেক এমপি দীপংকর তালুকদারের ছত্রছায়ায়। তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। পাশাপাশি তার সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য হাজি মো. মুছা মাতব্বর, সহসভাপতি ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য রেমলিয়ানা পাংখোয়া।