রাজধানীর গুলশান ও বনানীসহ বেশকিছু এলাকার পয়োবর্জ্য পরিশোধন করতে ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ে দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু পয়োবর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছানোর পাইপলাইন (নেটওয়ার্ক) তৈরি না হওয়ায় মুখথুবড়ে পড়েছে প্রকল্পটি। এক টাকা রাজস্ব আয় না হলেও এ প্রকল্পের পেছনে প্রতিষ্ঠানটি বছরে খরচ করছে প্রায় ২২৫ কোটি টাকা। কাজ অসম্পূর্ণ থাকলেও বিল ঠিকই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারকে।
একইভাবে সাভারের ভাকুর্তা প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও ঠিকাদারকে নিয়ে গেছেন ৫৭৩ কোটি টাকার বিল। যশলদিয়া থেকে পদ্মা নদীর পানি ঢাকায় সরবরাহের জন্য নেওয়া ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প ডুবেছে পাইপ কেনায় নয়ছয় করায়। ঢাকা ওয়াসার ৮ হাজার ৮৫ কোটি টাকার এই তিন মেগা প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন সংস্থার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। দেশের দুর্নীতিবাজদের নামের তালিকায় আইকন হিসেবে জায়গা করে নেওয়া এই ব্যক্তি সাত দফায় ওয়াসার এমডি হয়ে গড়েছেন রেকর্ড। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় পরিচয়ে বরাবরই অধরা থেকে গেছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এই এমডি।। প্রকল্পে দুর্নীতি, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে টেন্ডারে মারপ্যাঁচ, কাছের অযোগ্য লোকদের প্রকল্প পরিচালক বানিয়ে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে প্রশস্ত করেছেন লুটপাটের পথ।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদের সরকারের যে বিকাশ ঘটেছিল তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। এক ব্যক্তির ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে অবারিত দুর্নীতি করা হয়েছে, বোর্ডকে কর্তৃত্বহীন করে রাখা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল ঢাকা ওয়াসার কর্মকান্ডের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কিন্তু তারাও কোনো সৎ সাহস দেখাতে পারেনি। অনিয়ম করে বছরের পর বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে রাখা হয়েছে তাকসিম এ খানকে। তার দুর্নীতির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে, গবেষণা প্রতিবেদন আছে। এসব দুর্নীতিবাজ অপরাধীকে চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
তাকসিম এ খানের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রবিউল কাইজার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তাকসিম এ খান মেগা প্রকল্পগুলোয় নিজের পছন্দের লোকদের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতেন। এই সিন্ডিকেটের যোগসাজশে চলত ওয়াসা। তাকসিমের এসব দুর্নীতিতে সায় না দিয়ে প্রতিবাদ করলেই চাকরিচ্যুত করতে মরিয়া হয়ে উঠতেন। আমাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমি গত ১২ বছর ধরে তাকসিমের এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আদালতের দুয়ারে ঘুরছি। দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে চাকরিচ্যুত করতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
‘ঢাকাসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় পানির চাহিদা পূরণকল্পে মিরপুরের ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা হ্রাসকরণ’ প্রকল্পের জন্য সাভারের ভাকুর্তা, তেঁতুলঝোড়া এবং কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নে জায়গা নির্বাচন করা হয়। ঢাকার পানির স্তর নিচে নামা ঠেকাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলার জন্য গভীর নলকূপ বসাতে বেছে নেওয়া হয় এই ইউনিয়নগুলোকে।
সরেজমিন সাভারের ভাকুর্তা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুরে পানি সরবরাহে নেওয়া ওয়াসার ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পে গভীর নলকূপসহ পাম্প বসানোর জায়গায় শুধু পাইপ বসিয়ে কাজ শেষ করেছে ঠিকাদার। ৪৬টি গভীর নলকূপ বসানোর কথা থাকলেও পাঁচটিতে পানি ওঠানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিই বসানো হয়নি। এ ছাড়া তিনটিতে শুধু নলকূপের পাইপ বসিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করে বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পে ধাপে ধাপে হয়েছে হরিলুট। এই প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৯ সালের ৭ জুলাই এ প্রকল্প অনুসন্ধান শেষে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় দুদক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট রয়েছেন।’ কিন্তু এসবের পরও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। মুন্সীগঞ্জের যশলদিয়া থেকে পদ্মার পানি পরিশোধন করে ঢাকায় সরবরাহে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেগা প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। শুরু থেকেই এ প্রকল্পে থাবা বসান তৎকালীন এমডি তাকসিম এ খান। বুয়েটে পরীক্ষা না করিয়ে কম পুরুত্বের নিম্নমানের ‘কে৯’ পাইপ ব্যবহার করা হয়। সমালোচিত ওই কে৯ পাইপ সরবরাহ না করতে ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী এম এ রশীদ সিদ্দিকী। তাকসিম তার বিরুদ্ধে গিয়ে ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়ায় সরিয়ে দেন প্রকল্প পরিচালককে। অনিয়ম করে প্রকল্প থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়েছেন তাকসিম। পদ্মা (যশলদিয়া) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর পরীক্ষামূলক চালু করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিকট শব্দে দুর্বল পাইপ ফেটে ফোয়ারার বেগে ছুটে আসে পানি, এমনকি ওই ভবনে পর্যন্ত ফাটল দেখা যায়। অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে রাজধানীর চারপাশের নদীদূষণ রোধে ২০১৫ সালে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিষয়ে বলা হয়, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, ডিওএইচএস, আফতাবনগর, বাড্ডা, নিকেতন, তেজগাঁও, ফার্মগেট এবং হাতিরঝিল ও এর আশপাশের এলাকার পয়োবর্জ্য পরিশোধন করে বালু নদে ফেলা। ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। শেষ না হওয়ায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি হলেও এতে ময়লা সংগ্রহের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়নি। কিন্তু কাজ শেষ না হলেও পুরো বিল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারকে। ফলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এখন কেবল হাতিরঝিলের একাংশের পানি পরিশোধন করতে পারছে। এ পরিশোধিত পানি বালু নদে গিয়ে অন্যান্য এলাকা থেকে আসা নোংরা পানির সঙ্গে মিশছে। যেনতেন এ কাজেই প্রতিষ্ঠানটি বছরে খরচ করছে প্রায় ২২৫ কোটি টাকা। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী, এটি পরিচালনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ হিসেবে দিনে খরচ সাড়ে ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাসায়নিক কেনা বাবদ ৮২ কোটি ৭৭ লাখ, বিদ্যুৎ বিল ২৫ কোটি ৭৫ লাখ এবং ডিজেল ও লুব্রিকেন্টে ২৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। পুরো প্রকল্পজুড়ে অনিয়মের ছড়াছড়ি। এক টাকা রাজস্ব না এলেও প্রতিবছর পরিচালন ব্যয় বাবদ বিপুল টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে এ প্রকল্পে।