বগুড়ায় জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি জিন্নাহ গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তার স্ত্রী ও শ্যালক হয়েছেন কোটিপতি। মাত্র দেড় বিঘা জমির মালিক ছিলেন বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনের এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। ক্ষমতার পালাবদলে বদলে ফেলেছেন নিজের ভাগ্য। তদবির ও নিয়োগ বাণিজ্য করে গড়েছেন শতকোটি টাকার সম্পদ। এমপি জিন্নাহ ক্ষমতায় থাকার কারণে ঘুষ, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নে শত কোটি টাকার চাঁদের হাট বসিয়েছেন তাঁর পুরো পরিবারে। স্ত্রী, শ্যালক ও পুত্র হয়েছিলেন জননেতা। জিন্নাহ এমপির ছেলে ছিলেন বগুড়া জেলা যুব সংহতির সাধারণ সম্পাদক। শ্যালক ফিরোজ আহম্মেদ রিজু ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তিন দফায় এমপি হয়েছিলেন জিন্নাহ। এমপি নির্বাচনের আগে মাত্র দেড় বিঘা জমির মালিক ছিলেন তিনি। নির্বাচিত হওয়ার পর ভাগ্যের পালাবদলে তিনি ৫০ বিঘা জমির মালিক বনে গেছেন। আওয়ামী লীগের জোট হিসেবে ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন জিন্নাহ। এর পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি জাতীয় পার্টি থেকে এমপি হন। ২০২৪ সালে আবারও এমপি হন তিনি। এরপর তার সম্পদ বেড়েছে কমপক্ষে ৩০ গুণ। তার পরিবারের সদস্যদের ধনসম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠেছে শতগুণ। ১০ বছর আগে স্ত্রী ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরা কোনো আয় না করলেও বর্তমানে তারা কোটিপতি। এ সবই সম্ভব হয়েছে পরপর তিনবার এমপি হওয়ার সুবাদে। ১০ বছর আগে যার অস্থাবর সম্পদের মূল্য ছিল ৮ লাখ টাকার নিচে। এখন তার অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে যার স্থাবর সম্পদ ছিল মাত্র ৫ লাখ টাকার, এখন তার স্থাবর সম্পদ ৪৯ গুণ বৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে আড়াই কোটি টাকা। ওই সময় তার স্ত্রীর কাছে নগদ টাকা ছিল মাত্র ৫০ হাজার। বর্তমানে স্ত্রীর হাতে নগদ রয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। স্ত্রীর বর্তমান অস্থাবর সম্পদের মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। সর্বশেষ নির্বাচনি হলফনামায় সব মিলিয়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার মালিক জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, তিনি ও তার পরিবার শতকোটি টাকার মালিক। তার স্ত্রী মহসিনা আক্তার পেশায় গৃহিণী। তবে দুজনে এখন শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। গত ১০ বছরে তিন দফায় এমপি হয়ে দুই হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়েছেন শরিফুল। শিক্ষক নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে ঘুষ আদায় এবং সৌরবিদ্যুতের নামে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে গত ১ অক্টোবর জিন্নাহকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৮৯ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ করা হয়। ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ কমিশনের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম মামলা করেন। মামলা দুটির তদন্ত চলছে।
শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তালিকায় ৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার মালিক তিনি। ১০ বছরের ব্যবধানে তার সম্পদ বেড়েছে পাঁচগুণ। স্ত্রীর সম্পদের পাহাড়ে জমা হয়েছে ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে নগদ ও ব্যাংকে মিলেছে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক আমানত ও নগদ অর্থ বেড়েছে অন্তত ১৪৪ গুণ। বর্তমানে এমপি জিন্নাহর দেড় বিঘা কৃষিজমি বেড়ে হয়েছে ৫০ বিঘা। যার মূল্য ৪৫ লাখ টাকা। পিছিয়ে নেই তার স্ত্রীও। মাত্র সাত শতকের কৃষিজমি থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ বিঘা। মূল্য দেখানো হয়েছে ২৭ লাখ টাকা। এমপি জিন্নাহর নামে ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা মূল্যের দুটি ভবন এবং ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকার একটি ফ্ল্যাট আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে একাডেমিক ভবন নির্মাণ করতে গেলেও জিন্নাহকে ৫ লাখ টাকা করে দিতে হয়েছে। টাকা না দিলে সেই প্রতিষ্ঠানকে ভবন দেওয়া হয়নি। এভাবে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তদন্তে এর সত্যতা পেয়েছে দুদক।
এদিকে সাবেক এমপি জিন্নাহর ছেলেকে বানিয়েছিলেন জননেতা। ছেলে হুসাইন শরিফ সঞ্চয় বগুড়া জেলা যুব সংহতির সাধারণ সম্পাদকের পদটি বাগিয়ে নেন। জিন্নাহর শ্যালক ফিরোজ আহম্মেদ রিজু ইউপি চেয়ারম্যান থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এমপির ক্ষমতার দাপটে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি হয়েছেন কোটিপতি। গড়েছেন সম্পদও। তার একটি বাহিনী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন বাণিজ্য করে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নিত। যার ভাগ ফিরোজ আহম্মেদ রিজু পেতেন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে জিন্নাহর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। তিনি এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। বগুড়া জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ক্ষমতার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। বগুড়ায় যে কয়েকজন জাপার এমপি ছিলেন তাদের কেউ কেউ দুর্নীতি করেছেন এমন খবর শুনেছি।