২৪ হিজরির ১লা মহররম ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ফারুক (রা.)-এর শাহাদাতের পর তৃতীয় খলিফা উসমান বিন আফফান (রা.) নির্বাচিত হন। ৩৫ হিজরির ১৮ই জিলহজে উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। তাঁর খিলাফতের মেয়াদ ছিল ১২ বছর। তাঁর খিলাফতকালে সাম্রাজ্যের ইসলামী সীমানা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। উসমানীয় যুগে ৪ জন সাহাবির নাম পাওয়া যায়, যারা ভারতবর্ষ পরিদর্শন করেছিলেন। তাঁদের নাম এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
উবাইদুল্লাহ বিন মামার আত তাইমি (রা.) আবু মুয়াজ উবাইদুল্লাহ বিন মামার বিন উসমান বিন আমর বিন কাব বিন সাদ বিন তাইম বিন মাররাহ কুরশী ছিলেন কুরাইশদের একটি বিখ্যাত শাখা বনু তাইমের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-ও এই শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বংশপরম্পরায় আমরের কাছে এসে তারা উভয়েই মিলিত হয় এবং তারা বংশীয় সূত্রে একে-অন্যের ভাই। উবায়দুল্লাহ (রা.)-কে সবচেয়ে কম সাহাবিদের মধ্যে গণ্য করা হয়। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৩৫; চাচনামা, পৃষ্ঠা ৪২০)
তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনার গৌরবও অর্জন করেছেন। তিনি আরব বিশ্বের বহির্গত অনারবি দেশগুলোতে যুদ্ধের ময়দানে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছেন।
উসমান (রা.) উবাইদুল্লাহ বিন মামার (রা.)-কে মাকরান অভিযানের সেনাপতি হিসেবে পাঠান, যেখানে তিনি গৌরবময় বিজয় অর্জন করেন। আল্লামা তাবারীর রেওয়ায়েত অনুযায়ী, উবাইদুল্লাহ (রা.) তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে এগিয়ে যান এবং ‘নাহার’ নামক স্থানে পৌঁছান। তারপর তাঁকে পারস্যের শাসক নিযুক্ত করা হয়। ২৯ হিজরিতে ইস্তাখার (Estakhr, Iran) নামক স্থানে এই মহান সাহাবি শাহাদাত বরণ করেন। একটি রেওয়ায়েত অনুযায়ী শাহাদাতের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৯ বছর এবং অন্য রেওয়ায়েত অনুযায়ী তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। (আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, পৃষ্ঠা ১০১৩; উসদুল গাবাহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা- ৫২৬; খিলাফতে রাশেদাহ আওর হিন্দুস্তান, পৃষ্ঠা ২৫৩-২৫৫)
উমাইর বিন উসমান বিন সাদ (রা.) উমাইর বিন উসমান বিন সাদ (রা.)-এর ইতিহাস আল্লামা তাবারী ‘তারিখে তাবারী’ এবং আল্লামা ইবনে আসির ‘আল কামিল’ গ্রন্থে ২৯ হিজরির ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার ভিত্তিতে উসমান (রা.) তাঁকে খোরাসানের শাসক নিযুক্ত করেন। অতঃপর তিনি খোরাসান থেকে ফারগানা পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল জয় করেন। এরপর হজরত উসমান (রা.) যখন উবাইদুল্লাহ বিন মামার আত তাইমি (রা.)-কে মাকরান থেকে পারস্যে স্থানান্তরিত করেন, তখন তিনি তাঁর জায়গায় উমাইর (রা.)-কে মাকরানের গভর্নর করেন। আর সম্ভবত উবাইদুল্লাহ (রা.) যখন ইস্তাখার নামক স্থানে শহীদ হন, তখন তাঁর স্থলে উমাইর (রা.)-কে পারস্যের শাসক করা হয়। সুতরাং উসমান (রা.) শাহাদাতের সময় হজরত উমাইর (রা.) ছিলেন পারস্যের শাসক। কাজী আতহার মোবারকপুরী (রহ.) লিখেছেন: ‘তারিখে তাবারি এবং আল কামিল গ্রন্থে বেশ কয়েকটি স্থানে এই নামটি একইভাবে এসেছে, তবে আমি ইতিহাস এবং রিজালশাস্ত্রের বইয়ে উমাইর বিন উসমান বিন সাদ (রা.)-এর নামে কোনো সাহাবির নাম উল্লেখ পাইনি। ধারণা করা হয়, এই সাহাবি হলেন উমাইর বিন সাদ বিন উবাইদ বিন নুমান বিন কায়েস বিন আমর বিন আওফ বিন মালিক আল আনসারি আল আওসি (রা.)। যাঁর পিতামহের নাম কিছু আলেম শহীদ বিন আমর বলে উল্লেখ করেছেন। (খিলাফতে রাশেদাহ আওর হিন্দুস্তান, পৃষ্ঠা ২৫৯)
এটি কাজী আতহার মোবারকপুরী (রহ.)-এর অনুমান মাত্র আর এর ওপর ভিত্তি করে তিনি উমাইর বিন সাদ (রা.)-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তবাকাতে সাহাবা ও রিজালের গ্রন্থগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখেন তিনি ভালো করেই জানেন যে একই নামের অনেক সাহাবা ছিলেন। তাই কোনো প্রমাণ ছাড়াই এ অনুমান সঠিক নয়, অথচ উমাইর বিন সাদ (রা.)-এর জীবনীতে খোরাসান ও মাকরান ইত্যাদির কোনো বর্ণনা নেই।
হাফেজ ইবনে হাজার আশকালানি (রহ.) সাহাবাদের পরিচিত সম্পর্কে একটি নীতি বর্ণনা করেছেন : শুধুমাত্র সাহাবায়ে কেরামদের গাজওয়াতে শাসক নিযুক্ত করা হত। যে কেউ যদি ফিতনায়ে রিদ্দাহ (ধর্মত্যাগ) এবং ইসলামের বিজয় সংক্রান্ত ইতিহাস পড়েন তাহলে এমন অনেক সাহাবি পাবেন। আর তিনি হলেন সেই সাহাবি যিনি প্রথম শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত (অর্থাত্ যিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দর্শন লাভের ও হাদিস বর্ণনার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন)। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৬১)
এটিই মূল নীতি যার ভিত্তিতে কাজী আতহার মোবারকপুরী (রহ.) উমাইর বিন উসমান (রা.)-কে সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (চাচনামা, পৃষ্ঠা ৪২০, খিলাফতে রাশেদাহ আওর হিন্দুস্তান, পৃষ্ঠা ২৫৮-২৬০)
মুজাশি বিন মাসউদ আস সুলামি (রা.) মুজাশি বিন মাসউদ আস সুলামি (রা.) হলেন একজন বিখ্যাত সাহাবি, যার রেওয়ায়েত সহিহাইন (বুখারি ও মুসলিম), মুসনাদে আহমাদ ও অন্য হাদিসের গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন আরব জাহিলিয়াতের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি ইমরুল কায়সের বংশধরদের একজন। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি ও তাঁর ভাই মুজালিদ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। মুজাশি (রা.) বলেন, আমি এবং আমার ভাই উভয়েই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাদেরকে হিজরতের উপর বায়আত নিন।’ তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘হিজরত তো হিজরতকারীগণের জন্য অতীত হয়ে গেছে।’ আমি বললাম, ‘তাহলে আপনি আমাদের কিসের উপর বায়আত নেবেন?’ আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইসলাম ও জিহাদের ওপর।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস ২৯৬২)
মুজাশি (রা.) তাঁর পুরো জীবন ইসলামের সেবায় অতিবাহিত করেছেন। ফারুকী ও উসমানীয় যুগের বিজয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। (তাহজিবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল, খণ্ড ২৭, পৃষ্ঠা ২১৬; আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, পৃষ্ঠা ১৪৫৭)
আবদুর রহমান বিন সামুরা আল কুরাশী (রা.) আবদুর রহমান বিন সামুরা বিন হাবিব বিন আবদে শামস বিন আবদে মানাফ (রা.) ছিলেন কুরাইশদের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। বংশপরম্পরায় আবদে মানাফের কাছে এসে তাঁর বংশ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে মিলিত হয়। সে অর্থে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বংশীয় ভাই। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর নাম ছিল আবদুল কাবা বা আবদুল কালাল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর নাম রাখেন আবদুর রহমান। তিনি রাসুল (সা.)-এর সাথে মুতা ও তাবুকের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ইরাক ও পারস্য বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন। খোরাসান ও সাজিস্তানের অভিযানে বহুবার তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২৩ হিজরিতে তিনি সাজিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের সময় পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৪২ হিজরিতে আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) পুনরায় তাঁকে অভিযানের জন্য সাজিস্তানে পাঠান। সে সময় তিনি ভারতের অনেক এলাকা জয় করেন।
ফুতুহুল বুলদানের বর্ণনা মতে, তিনি জারঞ্জ (Zaranj-Afghanistan) নামক স্থানে কাফেরদের ঈদের দিন মারজুবানকে (ইরানী সর্দার) তার প্রাসাদে ঘেরাও করেন। অতঃপর মারজুবান বিশ লাখ দিরহাম এবং দুই হাজার ওয়াসাইফের (দাসী) উপর সন্ধি করে। এরপর ইবনে সামুরা (রা.) ভারতের সে অঞ্চল যা জারঞ্জ ও কিশের মধ্যবর্তী এবং রুখজ (Arachosia) ও দাওয়ার প্রদেশের (ইয়েমেন) মধ্যবর্তী অঞ্চল জয় করেন। দাওয়ার প্রদেশে পৌঁছে সেখানকার বাসিন্দাদের জাবাল আল-জাওয়ারে (Jabal az Zawr-Yemen) অবরোধ করেন। অতঃপর তারা নিরাপত্তা এবং সন্ধি স্থাপন করে নেয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আট হাজার মুসলমান। গনিমতের মাল ভাগ করা হলে প্রত্যেকে চার হাজার (দিরহাম) পান। (ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৫৫৫)
আবদুর রহমান বিন সামুরা (রা.) ভারতের অনেক এলাকা জয় করেন। শেষ যুগে তিনি বসরায় চলে আসেন এবং এখানেই ৫০ বা ৫১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। (তাহজিবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা ১৫৭; ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৫৫৮)
বিডি প্রতিদিন/এমআই