দেশের অন্যতম রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত এই শিল্পী। গতকাল সকাল ৮টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জানা যায়, বেশ কিছু দিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, তবে আর ফিরলেন না। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পাপিয়া সারোয়ার স্বকীয়তায় ও সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন রাবীন্দ্রিক আবহকে। কেবল দেশ নয়, দেশের বাইরেও জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে একের পর এক গান দিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন এই গুণী শিল্পী।
পাপিয়া সারোয়ারের জন্ম ১৯৫২ সালে ২১ নভেম্বর, বরিশালে। বাবা সরকারি কর্মর্র্কতা আর মা ছিলেন গৃহিণী। যদিও তাঁর মা কবিতা লেখতেন। আট ভাইবোনের মধ্যে পাপিয়া ছিলেন পঞ্চম। পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের কারণে শৈশব থেকেই তাঁর গানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। সে কারণে ১৪ বছর বয়সে পাপিয়া ছায়ানটে ভর্তি হন। তিনি ছায়ানটে ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন ও জাহেদুর রহিমের কাছে এবং পরে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে সংগীতে দীক্ষা নেন। ১৯৬৭ সাল থেকে বেতার ও টিভিতে তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে গান করেন তিনি। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। কিশোরী বয়সেই এই গায়িকা শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। গানের সঙ্গে পড়াশোনা দুই-ই চালাচ্ছিলেন পাপিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন তিনি। গায়িকায় বয়স যখন ২১ তখন নতুন সূচনা করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীতে ডিগ্রি নিতে ভারতে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই প্রথম ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেখানে স্নাতক করার সুযোগ পান। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা সেনের অধীনে রবীন্দ্রসংগীত এবং ধ্রুবতারা যোশীর অধীনে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছেন। রবীন্দ্র-অনুরাগী পাপিয়া সে সুযোগটা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগান। নিজেকে সমৃদ্ধ করেন তিনি, সেই সঙ্গে সংগীত অঙ্গনেও পাকাপোক্ত স্থান করে নেন।
পাপিয়ার প্রথম অডিও অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। অ্যালবামটির নামও ছিল শিল্পীর নামেই, ‘পাপিয়া সারোয়ার’। গানের সঙ্গে সংসার সামলেছেন সমান তালে। ১৯৭৮ সালে সারোয়ার আলমের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে জারা সারোয়ার কলেজ অব নিউ জার্সিতে জীববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক এবং ছোট মেয়ে জিশা সারোয়ার কানাডার অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন নির্বাহী। অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে ‘গীতসুধা’ নামে একটি গানের দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাপিয়া। ব্যতিক্রমী কণ্ঠ ও গায়কীর জন্য পাপিয়ার সুনাম ছিল সংগীতাঙ্গনে। আধুনিক গানেও আছে তাঁর সাফল্য। ‘নাই টেলিফোন নাই রে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম’ গানটি তাঁকে আপামর বাংলাগানের শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা দিয়েছে। সংগীতবোদ্ধাদের মতে, আধুনিক গান বাছাইয়ে বেশ সচেতন ছিলেন বলে তাঁর অ্যালবামের সংখ্যা কম। দীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ারে রবীন্দ্রসংগীতের জন্য কোটি শ্রোতার ভালোবাসা পাপিয়া সারোয়ার পেয়েছেন। সেই সঙ্গে পেয়েছিলেন একাধিক পুরস্কার। পাপিয়া সারোয়ার ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ লাভ করেন। ২০২১ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। পাপিয়া সারোয়ার জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন এক সময়। সর্বশেষ এই পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পী চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না তাঁর ভক্তরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা ভালোবাসার কথা প্রকাশ করছেন।