পর্ব-২
আমার আপত্তি নেই কিছুতেই। কিন্তু তরুর সঙ্গে আমার পরিচয় খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে এলে একদিন এক চিঠির মধ্যে আবিষ্কার করি- আমার নামের আরও এক দফা রূপান্তর ঘটেছে। তরু আমাকে সোনামণি বলে সম্বোধন করেছে। দুই পৃষ্ঠার চিঠিতে কী লেখা আছে, তখন তার চেয়ে ঢের বড় হয়ে ওঠে ওই নতুন সম্বোধনটুকু। তখন তরু আমার কাছে নেই, হাতের মুঠোয় ধরা আবেগমাখা অসাধারণ চিঠি; সেই চিঠির পাতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তরুর মুখচ্ছবি। প্রথমে হালকা জলছাপ- এই আছে এই নেই, তারপর ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হয়ে স্বচ্ছ ছবি, লজ্জারাঙা তরুর হাসিমাখা মুখ। আমি চিঠির পাতায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় দিব্যি দেখতে পাই- তরুর পাতলা দুটি ঠোঁট কেঁপে উঠছে, নড়ে উঠছে, উচ্চারিত হচ্ছে সোনামণি! আমি তো প্রথমে চমকে উঠি। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখি- কেউ শুনে ফেলল না তো! নাহ! চারপাশে কেউ নেই, তা কে শুনবে! আমি শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রাখর্য ঢেলে আবার কান খাড়া করি, আবার বেজে ওঠে সুরের নিক্বণ, সোনামণি!
সেই থেকে সকাল দুপুর সাঁঝ, দিবস রজনী ওই এক ঘোরের মধ্যে কাটে; আমি যেন কান পাতলেই তরুর কণ্ঠের মিষ্টি সুবাস ছড়ানো সম্বোধন শুনতে পাই-
সোনামণি!
হুঁ!
বল না- কী হয়েছে?
কিছুই হয়নি।
কিছু না।
না।
আচ্ছা থাক। এখন তোমার বলতে ইচ্ছে করছে না, আমি বুঝেছি। থাক, তুমি অন্য সময় বলো।
এবার আমি অকস্মাৎ প্রবলভাবে জাপটে ধরি তরুকে, বুকের মধ্যে ওকে পিষে ফেলি আনন্দে-বেদনায়-উচ্ছ্বাসে, বলে উঠি,
কী করে টের পাও তুমি? কিচ্ছু আড়াল থাকতে নেই?
আড়াল! মানে?
আজ তোমাকে মিথ্যে বলেছি তরু।
তরু নীরব।
মিথ্যে বলাও এত কঠিন, জানতাম না।
তরুর মুখে কথা নেই। আমারই দুই হাতের মধ্যে তার পুরো শরীর। কিন্তু সেই শরীরে বুঝি কোনো স্পন্দন নেই। সাড়া-শব্দহীন নিরেট পাথর। ওর প্রতিক্রিয়াহীনতা আমাকে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ করে। শেষে রেগে মেগে দুম করে বলেই ফেলি আজকের ইন্টারভিউ আমি দিইনি তরু।
আমার হাতের বাঁধন থেকে তরু খুব ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। মুখে কিছুই বলে না। আমার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে। মানুষের দৃষ্টি কি এতই শক্তিশালী! ঘরভর্তি আবছা অন্ধকারেও আমার খুব মনে হয়- তরু সব দেখতে পাচ্ছে। ভীষণ অন্তর্ভেদী ওই দৃষ্টি। মনে মনে ভাবি- বেশ তো! চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার নাম করে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাই, দিন শেষে ফিরে এসে বলি চমৎকার হয়েছে ইন্টারভিউ। কেন বলি? বিবাহিত স্ত্রীর কাছে এত দিন পর কেন আমাকে মিথ্যে বলতে হলো, তরুর ওই সূচাগ্রদৃষ্টি কি পারে সেই দুষ্পাঠ্য কারণ উদ্ধার করতে?
আমি মিথ্যে বলেছি জেনেও তরু আমাকে কিছুই বলে না। কোনো প্রশ্ন করে না। আমার চোখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর নিজেই এক সময় দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। আমাকে বলার মতো কিংবা প্রশ্ন করার মতো কোনো কথা যেন খুঁজে পায় না। অকারণেই নিজের দুহাতে মুখ ঢাকে চোখ ঢাকে, আবছা অন্ধকারেও আমি টের পাই ওর শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। খানিক পরে মৃদু ফোঁপানিও শুনতে পাই। ভয়ানক বিব্রতবোধ হয়। স্ত্রীর কাছে সত্য স্বীকারের পর আমি ভারমুক্ত হতে পারব ভেবেছিলাম, কিন্তু তেমন কেন হচ্ছে না! এত কাছে তরু, তবু এমন নিঃসঙ্গ কেন বোধ হচ্ছে! আমি কোথাও কোনো কূল-কিনারা না দেখে শেষ পর্যন্ত তরুর দিকেই হাত বাড়াই। ওর কাঁধে হাত রেখে আমি জানাই,
ওই চাকরি আমার হতো না তরু।
কাঁধ থেকে আমার হাত নামিয়ে দিয়ে তরু মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে। আমার কণ্ঠে তখন অসহায় আর্তনাদ স্ফুট হয়ে ওঠে,
তরু!
রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়।
তরু! প্লিজ, আমার কথা শোনো। আমি খুব ভালো করে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই অফিসে যাদের নেওয়া হবে, আগে থেকেই তাদের ঠিক করা আছে। ইন্টারভিউয়ের নামে শুধু সাজানো নাটক। আমি জেনে-শুনে সে নাটকে নামতে যাব কেন?
এ রকম একটা ব্যাখ্যা যে আমি দিতে পারি সে কথা যেন জানা ছিল তরুর। তাই এ নিয়ে আমার কোনো কথা জানা বা শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বুঝি ওর নেই। কী যে শীতল, নিষ্পৃহ, নির্বিকার। আমার অসহ্য লাগে। তবু আমি একা একাই ব্যাখ্যা দিই, আজকের এই একটা ইন্টারভিউয়ের কথা না হয় ছেড়েই দাও, এ নাগাদ ইন্টারভিউ তো কম দিলাম না তরু! ফলাফল তো সেই যথা পূর্বং তথা পরং। চাকরি আমার হবে না, বুঝে গেছি।
দুই
কথাটা যে ঠিক হলো না, বলে ফেলার পরই তা টের পাই। চাকরির বাজার খুবই চড়া বটে, তবু তো মাস ছয়েক আগে চাকরি একটা পেয়েছিলাম। হোক এনজিওর চাকরি, তবু সেটা চাকরি তো বটে! অভিজ্ঞতা ছাড়া যেখানে দরখাস্তই করা যায় না, কী ভেবে যেন এই প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেনি। সোজা ইন্টারভিউ। অপ্রাসঙ্গিক আবোল-তাবোল কোনো প্রশ্নের আস্ফালন নেই, ওদের নির্দিষ্ট কর্মসূচি ভিত্তিক কিছু আলোচনা। সেখানে আমার অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত সপ্রতিভ। চাকরিটা হয়ে গেল একেবারে হুট করে। পদের নাম কর্মসূচি সংগঠক। শুরুতে বেতন এমন আহামরি কিছু নয়। ছয় মাস পর চাকরি কমফার্ম হলে নতুন স্কেলে বেতনও বাড়বে। এক সপ্তার ট্রেনিং শেষে কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে। গোল বাঁধল এইখানে এসে। আমার পোস্টিং যশোরের অভয়নগরে। ঢাকা ছেড়ে, সর্বোপরি তরুকে ছেড়ে আমি যাব কী করে!
তখন চাকরিপ্রাপ্তির এই সুসংবাদে দুজনের কেউই আমরা আনন্দিত হতে পারিনি। হাতে সময় অত্যন্ত কম, যা হোক একটা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে। সময় বলতে ট্রেনিংয়ের সাত দিন। উহ্! কী যে টেনশনে কেটেছে সেই সাতটা দিন! সকালে উঠে যে যার মতো বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি বটে, অফিস শেষে বাসায় এসেই শুরু হয় ওই এক প্রসঙ্গের গাওনা। আমি এই চাকরিতে গেলে কী কী সুবিধা, আর অসুবিধাই বা কত রকম তাই নিয়ে আলোচনা। সে আলোচনা অনেকটাই একপক্ষীয়। তরু সেই প্রথম দিনেই তার অভিমত জানিয়ে দিয়েছে- এ চাকরি করতে হবে না। যেভাবে চলছে চলুক।
চলছে মানে তো শুধু ওই তরুর একার চাকরির মাইনে আর আমার গোটা দুই টিউশনির উপার্জন- এতেই সংসার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এ অবস্থায় আমার একটা চাকরি খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে চাকরির বদলে তরুকে ছাড়তে হবে! এ হিসাব মেলাতেই পারি না। গভীর রাতে শরীরে শরীর ঘষে আগুন লাগা মুহূর্তে তরু স্পষ্ট জানিয়ে দেয়- না, আমি কোথাও যেতে দেব না।
তরুর চাকরিতে ট্রান্সফার নেই। শুনেছি আমারটায় সে সুযোগ আছে। কিন্তু ছয় মাস পেরোনোর আগে সে কথা মুখেও আনা যাবে না। তাহলে আমি কী করব? ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর পর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চাকরির ইন্টারভিউ তো এ নাগাদ কম দিলাম না। সাফল্য বলতে এত দিনে এই এনজিওর চাকরি লাভ। তরুকে আপাত ছাড়তে হবে বলে সেই চাকরি আমি করব না? একা একা বাসায় থাকা অসম্ভব মনে হলে তরু না হয় এই ক’মাসের জন্য বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে। মোহাম্মদপুরে বাবার বাড়ি। মোহাম্মদপুর টু মতিঝিল এখন নানা রকম বাস চলাচল করে। ওর অফিস করারও কোনো অসুবিধা নেই। না, সে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে নিজের ইচ্ছেমতো, এখন আর মাথা নিচু করে সেখানে ঢুকতে পারবে না। এই তার সাফ কথা। অথচ ওই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ যে মোটেই নেই, তা কিন্তু নয়। বিয়ের পর এক রকম গিটবাঁধা গুমোট পরিবেশ বিরাজ করেছে বেশ ক’মাস। তারপর ওর ছোট বোন তৃণা এসেছে, এসেছে মানে ইউনিভার্সিটি থেকে এখনো চলে আসে মাঝেমধ্যে, দীর্ঘসময় ধরে তরুর সঙ্গে গল্পগুজব করে, শুনেছি একদিন নাকি ওদের বড় ভাবিও এসেছিলেন তরুকে দেখতে। কেবল তরুকেই দেখতে এসেছিলেন। আমি তখন বাসায় ছিলাম না। আমার জন্য অপেক্ষাও করেননি। তৃণা এবং বড় ভাবি দুজনেই জানিয়েছে- তরুকে দেখার খুব সাধ মায়ের; কিন্তু রাশভারি প্রকৃতির মানুষ হচ্ছেন ওদের বাবা, তাঁর অনুমতি নেই বলেই মায়ের আসা হয় না। তবে একদিন ঠিকই চলে আসবেন, এসে মেয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবেন।
আর জামাই?
তরু এই জায়গাতে সাংঘাতিক অনড়। আমার এতটুকু অসম্মান হয় এমন কাজ করবেই না, এমন জায়াগায় যাবেই না।
কাজেই আমার পক্ষে যশোরের অভয়নগরে চাকরি করতে যাওয়া সম্ভব হবে না, এটা একরকম নিশ্চিত হয়েই যায়। তাহলে আর এই এক সপ্তার ট্রেনিং নিয়ে কী কাজ! সকালে উঠে সেই মহাখালী যাওয়া কি সোজা কথা? চাকরি না করলে এই টানাহেঁচড়া করে লাভ কী! এ বেলায় তরু আবার বেশ ঠেলে পাঠায় যাও না যাও, প্রশিক্ষণ ভালো কাজ। প্রশিক্ষণ মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, দক্ষতা বাড়ায়। বলা যায় না, কোন দক্ষতা যে কখন কোথায় কাজে লেগে যায়।
এভাবেই আমার সাত দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। অবাক কান্ড হচ্ছে প্রশিক্ষণ শেষে কেমন করে জানি না আমার সিদ্ধান্তই পাল্টে যায়।
প্রশিক্ষণ শেষ হয় বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায়। শুক্রবার ছুটি। কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে শনিবারে। সহ-প্রশিক্ষণার্থীদের অনেকের সঙ্গেই ঠিকানা বিনিময় হয়, চাকরিপ্রাপ্তির আনন্দে হা হা হাসাহাসি হয়, ঝিনাইদহের কলিগ তো জোর দাবিই জানিয়েছেন আমি যেন অভয়নগর যাওয়ার পথে আগের দিন তার ওখানে নেমে পড়ি। রাতভর জম্পেশ আড্ডা হবে, তারপর সকালের বাস ধরিয়ে দেবেন। ঝিনাইদহ থেকে অভয়নগর ঘণ্টা দেড়েকের পথ। অসুবিধা কিছুই নেই। প্রশিক্ষণ শেষে কর্তৃপক্ষ সবার হাতে হাজার দেড়েক টাকা তুলে দিয়েছে; মাত্র এক হাজার পাঁচশ টাকা। সেটুকুই কে কীভাবে খরচ করবে তাই নিয়ে মহাপরিকল্পনা শুনতে পাই। বাসায় ফিরে এসব সাতকাহনের কেচ্ছা মেলে ধরি তরুর সামনে। শুনতে শুনতে তরুর কখনো হাসি পায়, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে; কখনো স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে-তার মানে তুমি অভয়নগরে যাচ্ছ?
আমি তার চোখ ছুঁয়ে দিব্যি দিই,
নাহ! তোমাকে ছেড়ে যাব কী করে?
তার মানে যেতে ইচ্ছে করছে ঠিকই, আমিই তোমার বাধা, তাই তো!
কী মুশকিল, আমি কি তাই বলেছি?
তার মানে, অর্থ করলে তাই দাঁড়ায়।
এরকম বাঁকা পথে তো কথার অর্থ তুমি করতে না তরু?
আমার মতো দশা হলে তুমিও তাই করতে।
তোমার মতো দশা মানে?
[চলবে]