শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

নবীদের জীবনে বিপদ ও পরিত্রাণ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

নবীদের জীবনে বিপদ ও পরিত্রাণ

আগুনের মাঝে অক্ষত থাকেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)

পবিত্র কোরআনের ১৪ নম্বর সূরার নাম ‘সূরা ইব্রাহিম’। ইসলামে হজরত ইব্রাহিম (আ.) খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে পরিচিত। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মেও হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে সম্মান করা হয়। বহু আগে জন্মগ্রহণ করায় হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঠিক জন্মকাল নিরূপণ করা কঠিন। তবে একদল গবেষকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮১৩ অব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩৮৩৩ বছর আগে তৎকালীন প্রাচীন শহর চালডিনসের উর এলাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে ইরাক নামে পরিচিত। অপর গবেষণায় তাঁর জন্ম বর্তমান তুরস্কের এডেসা অঞ্চলের আসিরিয়ান শহরে বলে দাবি করা হয়। তাঁর বাবার নাম পবিত্র কোরআন অনুসারে আজর, তবে যিনি তেরাহ নামেও কোনো কোনো ইতিহাসগ্রন্থে পরিচিত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন হজরত নূহ (আ.)-এর বংশধর। তাঁর পিতা ছিলেন মূর্তি উপাসক। পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ নবুয়তদানের মাধ্যমে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে একাত্মবাদের সন্ধান দেন এবং তাঁর গোত্রকে একাত্মবাদে আহ্বান করার আদেশ দেন। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মতের অমিল হয় এবং তাঁর বাবা তাঁকে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলার হুমকি দেন। কিন্তু হজরত ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন মহান আল্লাহর একাত্মবাদ প্রচার এবং তাঁর বংশকে সঠিক পথে পরিচালনায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। পরে তিনি তাঁদের দেব-দেবীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে থাকেন। এ সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে পবিত্র কোরআনের ২১ নম্বর সূরা আম্বিয়ার ৫১ থেকে ৭৩ নম্বর আয়াতে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা মতে, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের দেব-দেবী বা মূর্তির অসারতা নিয়ে মতপার্থক্য ঘটে। কিন্তু পিতা ও সম্প্রদায় তাদের পূর্বপুরুষের প্রথা তথা মূর্তি পূজা ছাড়তে রাজি ছিল না। সূরা আম্বিয়ার ৫৮ নম্বর আয়াত অনুসারে এ পর্যায়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাদের উপাসনালয়ের প্রধান বা বড় মূর্তি অক্ষত রেখে বাকি সব মূর্তি ভেঙে দেন। তাফসির মতে, এরপর যে কুঠার দিয়ে মূর্তিগুলো ভাঙা হয়, সে কুঠার বড় মূর্তির গলায় ঝুলিয়ে দেন। মূর্তি উপাসকদের বুঝতে বাকি থাকল না যে এটা কার কাজ। কিন্তু বড় মূর্তি ছোট মূর্তিদের রক্ষা করতে না পারায় এবং বড় মূর্তির গলায় কুঠার থাকায় তারা দাবিও করতে পারছিল না যে এসব দেব-দেবী ক্ষমতাবান এবং তাদের সম্প্রদায়ের রক্ষাকর্তা। ইব্রাহিম (আ.)ও তাঁর সম্প্রদায়কে বলেন, তাঁরা যেন তাঁদের তথাকথিত ক্ষমতাবান দেব-দেবীদের জিজ্ঞেস করে এটা কার কাজ। পবিত্র কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ৬৫ নম্বর আয়াতে এভাবে তাদের মাথা হেঁট হওয়ার বর্ণনা রয়েছে।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে মূর্তি পূজারিরা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে পুড়িয়ে তাদের দেব-দেবীর সন্তুষ্টি আদায়ের পরিকল্পনা করে বলে একই সূরার ৬৮ নম্বর আয়াতে বর্ণনা রয়েছে। গবেষক এবং ইতিহাসবিদগণ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এলাকাকে ব্যাবিলন বলে মত প্রদান করেন। যার প্রধান বা সম্রাট ছিলেন নমরুদ। তাফসির মতে, তাঁর সম্প্রদায় ও নমরুদ সম্মিলিতভাবে তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে, এক মাস ধরে সমগ্র শহরবাসী বিরাট গর্ত করে, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে এবং আগুনে পোড়ানোর যাবতীয় আয়োজন করে। এই আয়োজনের খবর ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোক জড়ো হতে থাকে। এরপর আগুন জ্বালানো হয় এবং সাত দিন ধরে আগুনের মাত্রা বাড়ানো হয়। সাত দিনের মাথায় আগুন এত তীব্র হয় যে, তাঁর কাছে মানুষ এমনকি পশুপাখির যাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর শয়তান এসে ‘মিনজানিক’ নামক এক ধরনের নিক্ষেপ যন্ত্র ব্যবহার করে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপের পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। তাফসির মতে, যখন ইব্রাহিম (আ.)-কে মিনজানিক নামক নিক্ষেপ যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনে ফেলা হচ্ছিল, তখন সব ফেরেশতা এবং পৃথিবী ও বেহেশতের সব প্রাণিকুল চিৎকার করে মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে বলে যে, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার বন্ধুর (খলিলুল্লাহর) একি বিপদ? মহান আল্লাহ তাঁদের সবাইকে অনুমতি দিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে সাহায্য করার জন্য। ফেরেশতাগণ সাহায্য করার জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর অনুমতি চাইলেন। আর ইমানি শক্তিতে বলীয়ান হজরত ইব্রাহিম (আ.) উত্তর দিলেন, ‘আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট। মাজহারির মতানুসারে এ সময় হজরত জিব্রাইল (আ.) বলেন, কোনো প্রয়োজন হলে আমি (জিব্রাইল আ.) হাজির আছি। উত্তরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলেন; প্রয়োজন তো আছেই তবে তা আপনার (জিব্রাইল আ.) কাছে নয়, পালনকর্তার (আল্লাহর) কাছে।

এমন শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে সেই মহাশক্তিশালী আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। পবিত্র কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ৬৯ নম্বর আয়াত অনুসারে মহান আল্লাহ এ সময় বলেন, ‘হে আগুন, তুমি ইব্রাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও’। তাফসির মতে, মহান আল্লাহর এই আদেশের পর হজরত ইব্রাহিম (আ.) অগ্নিকু-ে আরাম-আয়েশে সাত দিন অবস্থান করেন। তাঁর আশপাশের সবকিছু এমনকি তাঁর হাত-পা বাঁধার জন্য ব্যবহৃত রশি বা দড়িও পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কিছুই হয়নি। ইতিহাস মতে, পরবর্তীতে হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলেন, এই সাত দিন আমি যে সুখভোগ করেছি, সারা জীবনেও ভোগ করিনি।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) ১৬৯ বছর বেঁচে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ধারণা মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪৪ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে অবস্থিত পুরাতন হেবরন শহরের পাটরিআরক্স নামক গুহায় সমাহিত করা হয়। একই স্থানে তাঁর স্ত্রী সারাহ, আরেকজন স্ত্রী রেবেকা, পুত্র ইসহাক এবং পুত্রবধূ লিয়াহর কবর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে একটি মসজিদের ভিতরে বুলেটপ্রুফ কাচ দিয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কবর সংরক্ষিত আছে। অন্যদিকে তুরস্কের সানলিন উরফা নামক স্থানে হজরত ইব্রাহিমের (আ.)-এর জন্মস্থান ও আগুনে নিক্ষেপের স্থানকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে ‘খলিলুল্লাহ মসজিদ’। সেখানে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। এখানে একটি গুহা রয়েছে, যেখানে নমরুদের ভয়ে গোপনে ইব্রাহিম (আ.)-কে জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর মা। দীর্ঘ সাত বছর এই গুহাতেই তাঁকে গোপনে লালন-পালন করা হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। আর যেখানে আগুন জ্বালানো হয়েছিল, সেখানে একটি মাছভর্তি বড় লেক রয়েছে। একদল মানুষ বিশ্বাস করে যে, আগুনের জন্য ব্যবহৃত কাঠ বা লাকড়ি পরবর্তীতে মাছে পরিণত হয়, তাই এ মাছ কেউ খায় না বরং খাবার কিনে মাছের জন্য ছিটিয়ে দেয়। আর লেকের পাশে রয়েছে মনোরম বাগান, আগুনের মাঝেই মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্য এরকম সুশোভিত বাগান তৈরি করেছিলেন বলে একাধিক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে।

 

ইতিহাস

সব নবীর জীবনেই বিপদ ছিল। পৃথিবীতে আগমনের শুরু থেকেই ক্রমাগত বিপদ মোকাবিলা করে মানুষ। পৃথিবীর প্রথম পুরুষ ও প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া (আ.) শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ ফল খেয়ে বেহেশত থেকে পৃথিবীতে প্রেরিত হন। পৃথিবীতে তখন কোনো মানুষ ছিল না, ছিল শুধু পশুপাখি সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ, জলজ প্রাণী প্রভৃতি। এমনই এক বিপদসংকুল পরিবেশে পৃথক দুটি স্থানে আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) অবতীর্ণ হন। কিন্তু বিপদে ধৈর্য না হারিয়ে তাঁরা মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাঁর অনুগ্রহ কামনা করেন। আল্লাহ ক্ষমা করলে আরাফাতের ময়দানে দীর্ঘদিন পর তাঁদের সাক্ষাৎ হয় এবং ক্রমে বংশবিস্তার ঘটে।

ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর অতি প্রিয় বন্ধু ছিলেন। অথচ জন্মের আগে বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর বিপদের শুরু। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি অসংখ্য বার বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে মহান আল্লাহ বহুবার তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন। কারণ সব বিপদেই তিনি আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখতেন এবং একমাত্র আল্লাহর সাহায্য চাইতেন। যুদ্ধের ময়দানে বেশ কয়েকবার তাঁর রক্ত ঝরে এবং দাঁত শহীদ হয়। অথচ আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি তাঁর শুকরিয়ার কোনো কমতি হতো না।

এভাবে দেখা যায়, প্রথম থেকে শেষ সব নবীর জীবনে বিপদ এসেছে। কিন্তু প্রত্যেক নবী ধৈর্য ধারণ ও মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করেই বিপদমুক্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের ৬৭ নম্বর ‘সূরা মুলক’-এর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে ‘যিনি (আল্লাহ) মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য যে কে তোমরা কর্মে উত্তম।’ প্রথম সূরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের (কাউকে) ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, আর (কাউকে) ধনেপ্রাণে বা ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করব। আর যারা ধৈর্য ধরে তাদের তুমি সুসংবাদ দাও।’ অন্যদিকে বিপদে পড়লে করণীয় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে একই সূরার ১৫৬ ও ১৫৭ নম্বর আয়াতে। এক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা “(তারাই ধৈর্যশীল) যারা তাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে ‘আমরা তো আল্লাহরই, আর নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁরই দিকে ফিরে যাব।’ এই সব লোকের প্রতি তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে আশীর্বাদ ও দয়া বর্ষিত হয়, আর এরাই সৎপথপ্রাপ্ত।”

 

কঠিন রোগ থেকে পরিত্রাণ পান হজরত আইয়ুব (আ.)

হজরত আইয়ুব (আ.)-এর জন্মের সঠিক সময় পাওয়া কষ্টসাধ্য, তবে ধারণা করা হয় যে, তাঁর আগমন ঘটেছিল হজরত ইয়াকুব (আ.) এবং হজরত মূসা (আ.) এর আগমনের মাঝখানে। তাঁর সম্ভাব্য জন্মস্থান বর্তমান জর্ডানে কিংবা সিরিয়ায়। একদল গবেষকের মতে, তাঁর জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৫৪০ অব্দে। বিভিন্ন বর্ণনা মতে, হজরত আইয়ুব (আ.) অত্যন্ত অর্থশালী ছিলেন। তাঁর প্রচুর ধনসম্পদ, বিশাল শস্যখেত বা চাষাবাদের জমি এবং শত শত গবাদিপশু ছিল। সন্তানাদি ও বংশধরের দিক থেকেও তিনি সমৃদ্ধ ছিলেন এবং তাদের সেবা করার জন্য তৎকালীন প্রথা অনুসারে একদল দাস-দাসীও ছিল। এত প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও তাঁর মাঝে কখনো কোনো অহংকার ভর করেনি, বরং তিনি সব সময় মহান আল্লাহর শোকর আদায় করতেন এবং প্রচুর দান-খয়রাত করতেন। ইসলামের ইতিহাসে বিপদে ধৈর্য ধারণ এবং মহান আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন হজরত আইয়ুব (আ.)।

বিভিন্ন গবেষণা মতে, আনুমানিক ৭০ বছর বয়সে তিনি এক কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত হন। ধীরে ধীরে এই রোগ তাঁর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। রোগের তীব্রতা এত প্রকট ছিল যে, তাঁর শরীরে পচন ধরে এবং পোকা জন্মায়। এ ছাড়াও পচা অংশ এবং পুঁজ থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। এর ফলে একে একে তাঁর ধনসম্পত্তি, জমি, টাকা-পয়সা, পশু, দাস-দাসী সবই হারিয়ে যায়। স্ত্রী রহিমা ছাড়া সবাই তাঁকে ত্যাগ করে এবং তাঁকে সমাজ থেকে নির্বাসিত করা হয়। এমন বিপদের দিনেও হজরত আইয়ুব (আ.) ধৈর্য হারাননি এবং মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর শুকরিয়া বা আনুগত্যে কোনো প্রকার ফাটল ধরতে দেননি। বলা হয় যে, তাঁর জিহ্বা এবং হৃৎপি- ছাড়া শরীরের অন্য সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পচন ধরেছিল। সেই জিহ্বা দিয়ে তিনি মহান আল্লাহকে ডাকতেন আর হৃৎপি- দিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া ও আনুগত্য প্রকাশ করতেন। এমনকি তাঁর শরীরের পোকা দেখেও তিনি মহান আল্লাহর অপার সৃষ্টি নিয়ে ভাবতেন এবং শুকরিয়া আদায় করতেন। দীর্ঘদিন তিনি এভাবে রোগে ভোগেন। বিভিন্ন বর্ণনায় তিনি ৩ অথবা ৭ বছর অথবা ১৮ বছর রোগে ভুগেছিলেন বলে তথ্য রয়েছে। স্ত্রী রহিমা ছাড়া সন্তান-সন্ততিসহ পরিবারের সবাই তাঁকে ছেড়ে যাওয়ায় নিন্দুকেরা বলতে থাকেন যে, হজরত আইয়ুব (আ.)-কে পাপে ধরেছে এবং তিনি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। এমন মানসিক কষ্টের মাঝেও হজরত আইয়ুব (আ.) মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখেন। পক্ষান্তরে তাঁর স্ত্রী রহিমা দীর্ঘদিন তাঁকে পরিষ্কার করা, দূরের কূপ থেকে পানি এনে গোসল করানোসহ যাবতীয় সেবা করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ওঠেন। একদিকে স্বামীর সেবা অন্যদিকে জীবনধারণের জন্য অন্যের বাড়িতে কটু কথা শুনে কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে হজরত আইয়ুব (আ.) চিন্তিত হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, তাঁর সব অঙ্গে পচন ধরেছে, শুধু জিহ্বাটুকু বাকি। এই জিহ্বায় পচন ধরলে তিনি কীভাবে মহান আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবেন এবং উচ্চকণ্ঠে শুকরিয়া আদায় করবেন? এই ভাবনা থেকেই তিনি মহান আল্লাহর কাছে আকুল ফরিয়াদ জানান। মহান আল্লাহ হজরত আইয়ুব (আ.)-এর এই আবেদনে সাড়া দেন বলে পরবর্তী ৮৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা সাদের ৪১ নম্বর আয়াত মোতাবেক হজরত আইয়ুব (আ.) মহান আল্লাহর উদ্দেশে বলেন, ‘শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্ট দিচ্ছে’। তাফসির মোতাবেক শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক কষ্টে জর্জরিত হজরত আইয়ুব (আ.) এবং তাঁর স্ত্রীর ইমান নষ্টের জন্য শয়তান তখন নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। ওই সূরার পরবর্তী ৪২ নম্বর আয়াত অনুসারে এ সময় মহান আল্লাহ হজরত আইয়ুব (আ.)-কে তাঁর দুই পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার নির্দেশ দেন এবং আঘাতকৃত স্থান থেকে শীতল পানি ওঠার সুসংবাদ দান করেন। হজরত আইয়ুব (আ.) নির্দেশ মোতাবেক দুই পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করলে মাটি ফুঁড়ে শীতল পানি বের হতে থাকে এবং সেই পানিতে গোসল করার পর হজরত আইয়ুব (আ.) আরোগ্য লাভ করেন। শুধু তাই নয়, সূরা আম্বিয়ার ৪৩ নম্বর আয়াত মোতাবেক মহান আল্লাহ হজরত আইয়ুব (আ.)-কে পরিবার-পরিজনসহ আপনজনদের ফিরিয়ে দেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এ ঘটনার পর তাঁর স্ত্রী রহিমাও তাঁর সৌন্দর্য ফিরে পান এবং তাঁদের সংসার আবারও ধনসম্পদে ভরে ওঠে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৪২০ অব্দে ১২০ বছর বয়সে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়। বর্তমান সুলতানাত অব ওমানের সমুদ্র তীরবর্তী শহর সালালাহর ইত্তিন পাহাড়ের ওপর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় একটি মাজারকে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর মাজার বলে দাবি করা হয়। মাজার থেকে অনেক নিচে একটি পানির কূপ রয়েছে, সেখান থেকে নবীর স্ত্রী রহিমা পানি এনে স্বামীকে গোসল করাতেন বলে অনেকের ধারণা।

 

মাছের পেট থেকে মুক্ত হন হজরত ইউনুস (আ.)

হজরত ইলিয়াস (আ.)-এর পরবর্তী জমানায় এবং হজরত জাকারিয়া (আ.)-এর আগমনের পূর্ববর্তী সময়ে সম্ভাব্য খ্রিস্টপূর্ব ৮২০ অব্দে হজরত ইউনুস (আ.)-এর জন্ম হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ এবং বিভিন্ন বর্ণনা মতে, বর্তমান ইরাকের দক্ষিণাংশে তৎকালে বসবাসকারীদের মূর্তি পূজা থেকে ফিরিয়ে আনতে মাত্র ৩০ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্ত হন হজরত ইউনুস (আ.)। পবিত্র কোরআনের ৩৭ নম্বর সূরা সাফসাতের ১৪৭ নম্বর আয়াত মোতাবেক মহান আল্লাহ হজরত ইউনুস (আ.)-কে ১ লাখ বা তার বেশি মানুষের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তবে বিভিন্ন বর্ণনা মতে, প্রায় ৩৩ (মতান্তরে) ৩৭ বছর হেদায়েত করার পর মাত্র দুজন তাঁর কথা বিশ্বাস করে এবং মহান আল্লাহর প্রতি ইমান আনে। হজরত ইউনুস (আ.) তাঁর সম্প্রদায়কে মূর্তি পূজার কারণে আল্লাহ প্রদত্ত ভয়ানক শাস্তির কথা বললেও তারা তা বিশ্বাস করত না। বরং পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলত, তাদের পূর্বপুরুষরা সব সময়ই মূর্তি পূজা করেছে এবং তাদের কোনো শাস্তি বা ক্ষতি হয়নি। এসব কথা ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ইউনুস (আ.) মনে কষ্ট পান এবং বিশ্বাস স্থাপন করানোর জন্য তাঁর সম্প্রদায়কে বিপদ বা শাস্তি প্রদানের জন্য ফরিয়াদ জানান। মহান আল্লাহ হজরত ইউনুস (আ.)-এর এই ফরিয়াদ কবুল করেন এবং একটি নির্দিষ্ট দিনে (কারও মতে শাওয়াল মাসের ১৬ তারিখ) তাঁদের শহরে কঠিন আজাব দেওয়ার কথা জানিয়ে দেন। সেই মতে হজরত ইউনুস (আ.) তাঁর সম্প্রদায়কে সাবধান করলেও তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। নির্দিষ্ট দিনের প্রাক্কালে হজরত ইউনুস (আ.) সবাইকে আবারও সাবধান করেন এবং সেই শহর ছেড়ে একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেন। নির্দিষ্ট দিনে আকাশের রং পরিবর্তিত হয় এবং আগুনের রং ধারণ করে। এতে শহরের সবাই ভয় পায় এবং প্রাণভয়ে চিৎকার করতে করতে কাঁদতে থাকে এবং নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। দলে দলে তারা শহর থেকে জঙ্গলে চলে যায় এবং শিশু-বৃদ্ধ-নারী ও পশুদের আলাদা করে যেন সবই একত্রে ধ্বংস না হয়। মহান আল্লাহ এতে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের ক্ষমা করেন এবং বিপদ উঠিয়ে নেন। পরবর্তীতে হজরত ইউনুস (আ.) শহরে ফিরে আসেন এবং তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না দেখে ধারণা করেন যে, মূর্তি উপাসকরা তাঁকে মিথ্যাবাদী বা ভ- ভাববে। তাই তিনি মানসম্মানের কথা ভেবে চিন্তিত হন। পবিত্র কোরআনের ৩৭ নম্বর সূরা সাফফাতের ১৪০ নম্বর আয়াত মোতাবেক শহর ছেড়ে নদী তীরে আসেন এবং নৌযান যোগে অন্যত্র পাড়ি জমানোর উদ্যোগ নেন। একই সূরার ১৪১ নম্বর আয়াত মোতাবেক নৌকা মাঝনদীতে যাওয়ার পর বিকল হয়ে যায়। অন্য বর্ণনা ও তাফসির মতে, ঝড়ের কবলে পড়ে। ঝড় থেকে বাঁচার জন্য প্রথমে সব মালপত্র নদীতে ফেলার বর্ণনা পাওয়া যায়। তবুও নৌকা সামলানো যাচ্ছিল না বিধায় তৎকালীন বিশ্বাস অনুসারে সবাই ভেবে নেয় যে, নৌকায় অলক্ষুণে কেউ আছে, তাকে নৌকা থেকে নদীতে ফেলে দিলেই বিপদ কেটে যাবে। সূরা সাফফাতের ১৪১ নম্বর আয়াত অনুসারে এ সময় নৌকায় ভাগ্য পরীক্ষা হয় এবং ভাগ্য পরীক্ষায় হজরত ইউনুস (আ.)-এর নাম নৌকা থেকে নামানো বা ফেলে দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হন। এর ফলে তাঁকে নৌকা থেকে ফেলে দেওয়া হলে এক বিশাল মাছ তাঁকে গিলে ফেলে বলে ১৪২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত। আর ১৪৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত এ সময় তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন যে, মহান আল্লাহর হুকুম ছাড়া সেই সম্প্রদায় এবং সেই শহর ছেড়ে এভাবে চলে আসা তাঁর ঠিক হয়নি। বর্ণনা মতে, হজরত ইউনুস এ সময় মাছের পেটের অন্ধকার, পানির নিচের অন্ধকার এবং রাতের অন্ধকার, এই তিন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলেন। তবে এমন বিপদে ধৈর্য না হারিয়ে তিনি মহান আল্লাহর পবিত্র মহিমা উচ্চারণ করতে থাকেন বলে একই সূরায় ১৪৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত। ইতিহাস ও বর্ণনা মতে, তাঁর ফরিয়াদ মাছের পেটের বাইরেও শোনা যায় এবং পানির অন্যান্য মাছ ও জলজপ্রাণী মহান আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করতে থাকে। বর্ণনা মতে, এভাবে তিন দিন তিন রাত কেটে যায়। সূরা সাফফাতের ১৪৫ নম্বর আয়াত মতে, এরপর আল্লাহর হুকুমে সেই মাছ তাঁকে তীরবর্তী তৃণহীন প্রান্তরে উদগিরণ করে বা বমি করে ফেলে যায়। তখন তিনি বেশ অসুস্থ বলেও একই আয়াতে উল্লিখিত। ১৪৬ নম্বর আয়াত অনুযায়ী আল্লাহ তখন হজরত ইউনুস (আ.)-কে ছায়া প্রদানের জন্য একটি লাউগাছের জন্ম দেন। বর্ণনা মোতাবেক মাছের পেটে থাকায় তিনি ছিলেন খুবই দুর্বল এবং তাঁর ত্বক রোদ সহ্য করার মতো ছিল না। ফলে লাউগাছের নরম পাতার ছায়ায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এভাবেই বিপদমুক্ত হন হজরত ইউনুস (আ.)।

পবিত্র কোরআনের ২১ নম্বর সূরা আম্বিয়ার ৮৭ নম্বর আয়াত অনুসারে হজরত ইউনুস (আ.) অন্ধকারে (মাছের পেটে) এই মর্মে প্রার্থনা করেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্না রাব্বি লা গাফুরুর রাহিম’ অর্থাৎ ‘তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নাই, তুমি পবিত্র মহান। আমি তো সীমা লঙ্ঘনকারী’। ৮৮ নম্বর আয়াত অনুসারে এই দোয়া পড়ার পর মহান আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া দেন এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করেন। এভাবেই মহান আল্লাহ বিপদ-আপদ থেকে বিশ্বাসীদের উদ্ধার করেন।

বিভিন্ন বর্ণনা মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ অব্দে ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন হজরত ইউনুস (আ.)। তাঁর নামে ফিলিস্তিনের হেবরন শহরের উত্তরে একটি পাহাড় রয়েছে। এই পাহাড়ে হজরত ইউনুস (আ.) মসজিদ নামে একটি মসজিদও রয়েছে। এই মসজিদের অভ্যন্তরে একটি কবর রয়েছে, যা হজরত ইউনুস (আ.)-এর কবর বলে ধারণা করেন এক শ্রেণির গবেষক।

 

একাধিক বিপদ থেকে রক্ষা পান হজরত ইউসুফ (আ.)

পবিত্র কোরআনের ১২তম সূরার নাম ‘সূরা ইউসুফ’। এই সূরার ১১১টি আয়াতের মাধ্যমে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর নানাবিধ বিপদে পড়া এবং মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহে সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। হজরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর ১১তম পুত্র। হজরত ইউসুফ (আ.) খ্রিস্টপূর্ব ১৭৮৯ অব্দে বর্তমান ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং লেবানন নিয়ে গঠিত ভূখন্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে গবেষকদের ধারণা। তাঁর পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর প্রথম স্ত্রী লাইয়া বিনতে লাইয়্যানের গর্ভে ১০ পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। লাইয়ার মৃত্যুর পর তারই ছোট বোন রাহিলকে বিয়ে করেন হজরত ইয়াকুব (আ.)। তাঁদের ঘরে জন্ম নেন দুই পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) এবং তাঁর ছোটভাই বেনিয়ামিন। ১২ পুত্রের মধ্যে হজরত ইউসুফ (আ.) -কে সবচেয়ে বেশি আদর করতেন তাঁর বাবা। অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য তাঁকে সবাই খুবই স্নেহ করতেন, যা তাঁর সৎভাইরা সহ্য করতে পারত না। ফলে তারা শিশু অবস্থায় ইউসুফ (আ.)-কে পিতা ইয়াকুব (আ.) থেকে দূরে সরানোর ঘৃণ্য পরিকল্পনা করে। তঁাঁর বাবা ইয়াকুব (আ.)-এর কাছে তারা ইউসুফ (আ.)-কে তাদের সঙ্গে বাইরে খেলতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান। হজরত ইয়াকুব (আ.) কখনো সুদর্শন পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে চোখের আড়াল হতে দিতেন না। তাই নেকড়ে বাঘ তাঁকে খেয়ে ফেলতে পারে উল্লেখ করে তাদের ফিরিয়ে দেন। তবে উপর্যুপরি অনুরোধ এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কথা বলে তারা বাবাকে রাজি করান। এরপর তাঁকে খেলতেও নিয়ে যান। এরপর তাঁকে প্রথমে হত্যার পরিকল্পনা করা হলেও বড় ভাইয়ের পরামর্শে তাঁকে হত্যার বদলে পানির কূপে ফেলে দেওয়া হয়, যেন অন্যরা পেলে তৎকালীন প্রথা অনুসারে তাঁকে দাস বানিয়ে রাখে বা বাজারে বিক্রি করে দেয়। পবিত্র কোরআনের সূরা ইউসুফের ৮ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে এ ঘটনার বর্ণনা আছে। একই সূরার ১৯ নম্বর আয়াতে রয়েছে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। তাফসির মতে, সিরিয়া থেকে মিসরগামী একটি কাফেলা এই কূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে মালেক ইবনে দোবর নামে এক ব্যক্তি পানি উত্তোলনের জন্য কূপে ডোল (এক প্রকার পানির পাত্র) দড়ি দিয়ে বেঁধে নিক্ষেপ করলেন। এই বালতি এবং দড়ি ধরে এ সময় বালক ইউসুফ (আ.) উপরে উঠে আসেন। এভাবেই বিপদ থেকে রক্ষা পান হজরত ইউসুফ (আ.)।

পানির কূপ থেকে উদ্ধার করে ইউসুফ (আ.)-কে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাঁকে কিনে নেন তৎকালীন মিসরের রাজদরবারের এক বড় কর্মচারী, যাকে ‘আজিজে মিসর’ বলা হতো। তাঁর স্ত্রী জুলেখা নানাভাবে সুদর্শন যুবক হজরত ইউসুফ (আ.)-এর চরিত্রহরণের চেষ্টা করেন। একদা তাঁকে ঘরে একা পেয়ে জুলেখা দরজা বন্ধ করে দিয়ে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে আহ্বান জানান বলে পবিত্র কোরআনের সূরা ইউসুফের ২৩ নম্বর আয়াতে উল্লিখিত আছে। একই আয়াত মতে, এমন বিপদের সময় ইউসুফ (আ.) বলেন, ‘আমি আল্লাহকে স্মরণ করছি (যিনি) আমার প্রভু। তিনি আমাকে সম্মানের সঙ্গে থাকতে দিয়েছেন। যারা সীমা লঙ্ঘন করেন, তারা অবশ্য সফল কাম হন না।’ এরপর ২৫ নম্বর আয়াত মতে, হজরত ইউসুফ (আ.) দৌড়ে দরজার দিকে গেলে জুলেখা পেছন থেকে তাঁর (হজরত ইউসুফ (আ.)-এর) জামা ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় তারা দরজায় গৃহকর্তা আজিজে মিসরকে দেখতে পান। নিজেকে বাঁচাতে জুলেখা বলেন, যে তোমার পরিবারের সঙ্গে কুকর্ম কামনা করে তার জন্য তাকে কারাগারে পাঠানো বা অন্য কোনো কঠিন শাস্তি ছাড়া আর কী শাস্তি হতে পারে? ২৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত এ সময় হজরত ইউসুফ (আ.) সঠিক ঘটনা বর্ণনা করেন এবং জুলেখার পরিবারেরই একজন সঠিক সাক্ষ্য প্রদান করেন। পবিত্র কোরআনে এই সাক্ষীর পরিচয় দেওয়া হয়নি। তবে তাফসির ও ইতিহাস মতে, এ সাক্ষী ছিল নিতান্ত এক কন্যাশিশু, যার মুখে তখনো কথা ফোটেনি। এভাবে মহান আল্লাহ তাঁর অসীম কুদরতে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পর জুলেখা নিজেকে সংযত করার পরিবর্তে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। সূরা ইউসুফের ৩২ নম্বর আয়াত অনুসারে জুলেখা এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে, ‘আমি তাঁকে যা বলি সে যদি তা না করে, তবে সে কারাগারে যাবেই এবং তাঁকে অপমান করা হবে।’ পরবর্তী আয়াত অনুসারে হজরত ইউসুফ (আ.) বলেন- ‘হে আমার প্রতিপালক, এই মহিলারা আমাকে যার দিকে ডাকছে তার চেয়ে কারাগার আমার অনেক প্রিয়।’ এমন প্রেক্ষাপটে মহান আল্লাহ হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ছলনাময়ী নারীদের থেকে বাঁচানোর জন্য নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও কারাগারে পাঠান। নির্দোষ হয়েও কারাগারের বন্দী জীবনে তিনি মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখেন এবং বন্দীদের সৎপথে এবং ইসলামের পথে ডাকতে থাকেন। কারাগারে বন্দী অবস্থায় এক যুবকের সঙ্গে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর পরিচয় ঘটে, যিনি মুক্তি পেয়ে মিসরের রাজদরবারে ঠাঁই পান। তার মাধ্যমে মহান আল্লাহ আরও কিছু নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে হজরত ইউসুফ (আ.)- কে জেলখানা থেকে মুক্ত করেন এবং সসম্মানে রাজদরবারে থাকার (মতান্তরে রাজ্য শাসনের) ব্যবস্থা করে দেন।

খ্রিস্টপূর্ব ১৬৩৫ অব্দে হজরত ইউসুফ (আ.) ১১০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বলে ধারণা করা হয়। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে নাবলুস শহরে ইউসুফ (আ.)-এর সমাধি রয়েছে বলে একদল গবেষকের ধারণা।

সর্বশেষ খবর