ছোটবেলায় ‘আলিবাবা এবং ৪০ চোর’-এর গল্প শোনেনি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন আলিবাবা নেই। কিন্তু গত সাড়ে ১৫ বছর এ দেশের মানুষ দেখেছে ‘দরবেশ বাবা’ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের লুটপাট। আলিবাবা এবং ৪০ চোরের বদলে শেখ হাসিনার আমলে হয়েছে ‘দরবেশ বাবা এবং ৪০ চোরের গল্প’। যে গল্প আরব্য রজনির গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর। পার্থক্য হলো আলিবাবা কেবল আরব্য রজনির একটি লোককাহিনি। আর দরবেশ বাবা একালের সত্য ঘটনা। এ দরবেশ বাবা আর কেউ নন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘ক্যাশিয়ার উপদেষ্টা’ সালমান এফ রহমান। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট এবং অর্থ পাচারের বিষয়ে তদন্ত করছে। অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে মামলা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। দুদকের এসব তদন্ত থেকে গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলের ৪০ জন শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তথ্য পাওয়া গেছে। দুদকের অভিযোগে এদের দুর্নীতির পরিমাণ ২০ লাখ কোটি টাকা। যে টাকার পুরোটাই বিদেশে পাচার হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, স্বাধীন দ্বীপপুঞ্জসহ বিশ্বের ১৭টি দেশে পাচার হয়েছে এসব লুণ্ঠিত অর্থ। এ ছাড়া সাবেক সরকারের এ রকম আরও অন্তত ৫০০ মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যারা বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এ লুটেরা, অর্থ পাচারকারী এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের মধ্যে শীর্ষ ৪০ জন লাগাতারভাবে দুর্নীতি করে গেছেন আওয়ামী লীগ শাসনামলে। দেশের অর্থনীতি ফোকলা করে দেওয়ার মূল খলনায়ক এ ৪০ জন। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে গড়ে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা করে পাচারের বা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে যে লুটপাট, ব্যাংক ডাকাতি এবং অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে তার মূল নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সালমান এফ রহমান বাংলাদেশের শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা। শেয়ার কেলেঙ্কারির থেকে তিনি প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে তৎকালীন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে প্রকাশ হয়েছিল। তার পরেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই সালমান এফ রহমান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ এবং তা বিদেশে পাচার করেছেন। লুটতন্ত্রের ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’ ছিলেন সালমান এফ রহমান। আর এ কারণে সবাই তাকে দরবেশ বলে ডাকত। এ দরবেশই বাংলাদেশে অর্থ পাচার এবং লুটেরাদের সরদার ছিলেন। তার নেতৃত্বেই এ কর্মকা গুলো ঘটেছে। তিনি একাই লুটেছেন ১ লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি শীর্ষ কিছু দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া দুদক বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে যে শীর্ষ ব্যক্তিদের পাহাড়সম দুর্নীতির আলামত পেয়েছে, সবকিছু মিলিয়ে আমরা এ প্রতিবেদনে শীর্ষ ৪০ জন দুর্নীতিবাজ এবং অর্থ পাচারকারীকে চিহ্নিত করেছি। যেসব অভিযোগ শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্টে, দুদকের তদন্তে এবং সংবাদপত্রের রিপোর্টের মাধ্যমে এসেছে তার ভিত্তিতেই এ ৪০ চোরের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যার প্রধান কারিগর দরবেশ বাবা। অর্থাৎ দরবেশ হলেন এ লুটেরাদের আলিবাবা এবং ৪০ চোর, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ রেহানার এখন পর্যন্ত ঢাকায় প্রায় ১০৬ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিদেশে তিনি প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের দেশে তেমন কোনো সম্পদ নেই। বিদেশে তিনি অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা গত সাড়ে ১৫ বছরে পাচার করেছেন বলে বিভিন্ন অনুসন্ধানে প্রাথমিক তথ্যে জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দেশে তার ১১৭ কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক শেখ রেহানার ছেলে। তার বিরুদ্ধে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সিআরআইয়ের বিরুদ্ধে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। শেখ রেহানার দেবর এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ছয়টি দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন বলেও অনুসন্ধানে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।
শেখ হাসিনার এক ভাই শেখ হেলালের বিরুদ্ধেও বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দেশে তার ৭৮৬ কোটি টাকার সম্পদের প্রাথমিক সন্ধান পাওয়া গেছে। তার ৩৬০ কোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া শেখ হেলালের বিরুদ্ধে বিদেশে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আরেক ভাই শেখ সেলিম। শেখ সেলিমের দেশের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫৪২ কোটি বলে এখন পর্যন্ত প্রাক্কলিত হয়েছে। তবে বেনামে তার আরও বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে তার প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। ফিজি, মরিশাস ও বার্বাডোজে শেখ সেলিমের সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়। শেখ তাপস বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে ১২ হাজার কোটি টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ টাকাই পাচার হয়েছে লন্ডন, সিঙ্গাপুরে। তার বড় ভাই যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনার আরও অনেক আত্মীয়স্বজন আছেন, যারা বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, তার ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ হেলালের ছোট ভাই শেখ সোহেলসহ আরও অনেকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্যই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। এদের শীর্ষ কয়েকজনের মধ্যে আছেন ওবায়দুল কাদের। যিনি দীর্ঘদিন ধরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার করেছেন বলে এখন পর্যন্ত অনুসন্ধানে দেখা গেছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং দুবাইয়ে তার অবৈধ সম্পদের সন্ধান মিলেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশেই প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন। এর কিছু আদালতের নির্দেশে জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বাইরে তার ১৮ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং তার পরিবার বিদেশে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। বেশির ভাগ সম্পদই দুবাইয়ে পাচার করা হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়াতেও লোটাস কামালের পাচারকৃত টাকা আছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দেশে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪৫২ কোটি টাকা। জাহিদ মালেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় বেশির ভাগ সম্পদ পাচার করেছেন। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু দুর্নীতিবাজদের অন্যতম এবং মন্ত্রীদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলে এখনকার অনুসন্ধানে দেখা গেছে। দেশে তার প্রায় ৯৬০ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার বেশির ভাগই আদালতের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা পাচার করেছেন। দুবাই, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অন্তত ১২ দেশে বিপুল সম্পদ থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে।
জুনাইদ আহমেদ পলক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দেশে তার প্রায় ৩২২ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী আরেকজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থের বেশির ভাগ তিনি পাচার করেছেন যুক্তরাজ্যে। এ ছাড়া দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্রে তিনি অর্থ পাচার করেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া মন্ত্রীদের মধ্যে যারা ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করেছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে আছেন সাবেক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
শেখ হাসিনার শাসনামলে শুধু যে রাজনীতিবিদরাই দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচার করেছিলেন এমন নয়, বহু আমলা বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। আমলাদের লুটপাটের সুযোগ দিয়ে শেখ হাসিনা তাদের নিজের অনুগত বানিয়ে রেখেছিলেন। যার ফলে আমলারা সীমাহীন দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিলেন পুরো আওয়ামী লীগ শাসনামলে। যেসব শীর্ষ দুর্নীতিবাজ বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, এসডিজিবিষয়ক সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ; সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস; সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা কবির বিন আনোয়ার, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম; সাবেক সচিব আবদুল মালেক; বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, ফজলে কবির; সাবেক বেসামরিক বিমান চলাচল সচিব মহিবুল হক; পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুনর রশিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. কামাল নাসের চৌধুরী এবং ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম আহমেদ খান। এসব অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে আবার ‘পঞ্চপা ব ব্যবসায়ী’ ছিলেন মূল কারিগর। যারা এসব রাজনীতিবিদ এবং আমলার অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেছেন। তাদের মাধ্যমেই এ ধরনের অর্থগুলো পাচার হয়েছে। যে কোনো দুর্নীতির ক্ষেত্রে তারা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। এসব দুর্নীতিগ্রস্ত কয়েকজন ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছেন মো. আজিজ খান, নজরুল ইসলাম মজুমদার, নাফিজ সরাফত এবং সবার ওপরে সালমান এফ রহমান। মূলত সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বেই এ চোরতন্ত্রের একটি মন্ত্রিপরিষদ ছিল, যে পরিষদে এ ৪০ জন চোর ছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশ লুট করা হয়েছে এবং কায়েম করা হয়েছিল একটি লুটেরাতন্ত্র।