গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের দুই বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল ৭ অক্টোবর। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে চলমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ১০ হাজার নিখোঁজ রয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ২ লাখ টনেরও বেশি বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেছে ইসরায়েল।
লেবাননের সংবাদমাধ্যম আল মায়েদিন জানায়, গাজার সরকারি জনসংযোগ কার্যালয় আগ্রাসনের দুই বছর উপলক্ষে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা, এবং লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে।
প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, দুই বছরে ৭৬ হাজার ৬০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত বা নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৭ হাজার ১৩৯ জনের মৃত্যুর তথ্য হাসপাতাল সূত্রে নিশ্চিত, আর সাড়ে ৯ হাজারের বেশি মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিহতদের অর্ধেকের বেশি নারী, শিশু ও প্রবীণ। ২০ হাজারের বেশি শিশু এবং ১২ হাজার ৫০০ নারী নিহত হয়েছেন। অন্তত ২ হাজার ৭০০ পরিবার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন, এবং আরও ৬ হাজার পরিবারে কেবল একজন সদস্য জীবিত আছেন।
গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে ৯০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। অঞ্চলটির ৮০ শতাংশেরও বেশি ভূমি এখন ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এ পর্যন্ত ২০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত, যাদের অনেকেই একাধিকবার স্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল এখন গাজায় ক্ষুধা ও জাতিগত নিধনের নীতি অনুসরণ করছে। গত দুই বছরে ২ লাখ টনের বেশি বোমা ও বিস্ফোরক বর্ষণ করা হয়েছে। এমনকি মানবিক সহায়তার নির্ধারিত নিরাপদ এলাকা আল–মাওয়াসিতেও ১৩০ বারের বেশি হামলা চালানো হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে ৩৮টি হাসপাতাল ও ৯৬টি ক্লিনিক ধ্বংস বা অচল হয়ে গেছে। ১৯৭টি অ্যাম্বুলেন্স লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৬০০ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, ২৫৪ সাংবাদিক, ১৪০ সিভিল ডিফেন্স সদস্য এবং ৫৪০ মানবিক সহায়তাকর্মী।
ইসরায়েলি আগ্রাসনে ১ লাখ ৬৯ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসার সক্ষমতা নেই বললেই চলে। বিদেশে চিকিৎসার অনুমোদন পাওয়া ২২ হাজার রোগী গাজার ভেতরেই আটকা, আর ৬ লাখ ৫০ হাজার শিশু ভয়াবহ খাদ্যসংকটে ভুগছে।
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার সতর্ক করে বলছে, গাজায় দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি চরমে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার ২৪ লাখ মানুষের প্রায় সবাই এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল, এবং তারা ‘অভূতপূর্ব বঞ্চনার শিকার’।
গাজার ৯৫ শতাংশ বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত, আর ১৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী, ৮৩০ শিক্ষক এবং ২০০ গবেষক ও শিক্ষাবিদ। পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছে ৮৩৫টি মসজিদ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকটি গির্জা এবং এমনকি কবরস্থানেও বুলডোজার চালানো হয়েছে।
গাজার ১৫টি খাত মিলিয়ে সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে আবাসন খাতে ২৮ বিলিয়ন, স্বাস্থ্য খাতে ৫ বিলিয়ন, এবং শিক্ষা খাতে ৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। কৃষি ও মৎস্য খাত কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে।
প্রতিবেদনের শেষাংশে আন্তর্জাতিক সমাজকে আহ্বান জানানো হয়েছে, গাজা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। ইসরায়েলের অবরোধ তুলে মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যদিও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত এখনো অগ্রসর হয়নি।
দুই বছর পূর্তির প্রাক্কালে গাজা এখন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে, ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে—‘এটি ৭৩০ দিনের গণহত্যা ও জাতিগত নিধন।’
সূত্র: আল-মায়েদিন
বিডি প্রতিদিন/আশিক