উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটে ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় তিস্তাপাড়ের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ। কোথাও কোথাও খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি ত্রাণ সহায়তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ করেছেন দুর্গতরা।
রবিবার রাতে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সোমবার সকালে তা কিছুটা কমে বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোববার মধ্যরাতে ব্যারাজ রক্ষায় ফ্লাড বাইপাস কেটে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিস্তা অববাহিকায় তখন জারি করা হয় রেড অ্যালার্ট।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানিয়েছেন, ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশ অংশে পানি বাড়ছে। ফলে বন্যার আশঙ্কা এখনো রয়ে গেছে।
সোমবার (৬ অক্টোবর) সকাল ৯টায় তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ১২ মিটার, যা বিপৎসীমার মাত্র ৩ সেন্টিমিটার নিচে। এর আগে রাতেই পানি ছিল বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপরে।
স্থানীয়রা জানান, গত তিনদিনের ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রবিবার সকাল থেকে ১২ ঘণ্টায় পানি বেড়েছিল ৮০ সেন্টিমিটার। এতে তিস্তা তীরবর্তী লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার কিছু অংশ প্লাবিত হয়।
বর্তমানে তিস্তা অববাহিকার পাঁচটি উপজেলার প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। পানির চাপে হুমকির মুখে পড়েছে বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বিশেষ করে আদিতমারী উপজেলার সোলেডি স্পার বাঁধ-২ এলাকায় সুরঙ্গ তৈরি হয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় বাঁধ ধসে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হাতীবান্ধার দোয়ানী-গড্ডিমারী সড়ক উপচে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় এখন চলছে মানবিক বিপর্যয়। শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পরিবারগুলো পড়েছে চরম দুর্ভোগে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন সড়ক বা উঁচু স্থানে। কেউ কেউ তাবু টানিয়ে বা মাচা বানিয়ে রান্না করছেন। ডুবে গেছে টিউবওয়েল, টয়লেট ও মাছের ঘের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন ধানসহ নানা সবজির খেত।
সিন্দুর্না এলাকার কৃষক রইচ উদ্দিন বলেন, বাড়ির উঠানে কোমর পানি। রাতভর ঘুমাতে পারিনি, শিশুদের কোলে নিয়ে জেগে ছিলাম। ভয় হয়, কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
গোবর্দ্ধন গ্রামের ছকমল মিয়া বলেন, হুহু করে পানি বাড়ছে। সব ফসল তলিয়ে গেছে, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনিল কুমার বলেন, উজানের ঢল ও স্থানীয় ভারি বৃষ্টির কারণে পানি বেড়েছিল। এখন তা বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। বৃষ্টির পানি থাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে উজানের চাপ কমে গেলে রাতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে।
অন্যদিকে, জেলা প্রশাসক রকিব হায়দার জানিয়েছেন, ত্রাণের কোনো অভাব নেই। প্রত্যেক বানভাসী পরিবারই সহায়তার আওতায় আসবে।
তবে বাস্তবে দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তিস্তাপাড়ের মানুষ এখনো অপেক্ষা করছে প্রকৃত সাহায্যের, আর তাদের মুখে ফুটে উঠছে একটাই আহাজারি—“কবে নামবে এই পানি?”
বিডি প্রতিদিন/হিমেল