১৯৪৯ সাল থেকে ২০২৫। সময়ের হিসাবে ৭৬ বছর। প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বয়স ৭৬ বছর। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আহমেদ আলী খান, শাখাওয়াত হোসেন, আবদুস সালাম খান, ইয়ার মোহাম্মদ খান, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা দলটির জন্ম দিয়েছেন। এ দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের যত বিখ্যাত তারকা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রায় ৭০ ভাগই ছিলেন এ দলটির তৈরি। একসময় এ দলের কর্মী হওয়া ছিল গর্বের বিষয়। স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগ নামের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুহাম্মদ মনসুর আলী, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের নামও পরিচিত হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, ড. কামাল হোসেন, সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, জোহরা তাজউদ্দীনসহ অসংখ্য তারকা রাজনৈতিক নেতা তৈরি করেছে দলটি। আওয়ামী লীগ নামের দলটির পরিচিতি ছিল সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নামে। ১৯৬৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পর থেকে দলটি পরিচিতি লাভ করে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ হিসেবে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব সপরিবার নিহত হওয়ার পর এক পর্যায়ে দলটির হাল ধরেন জোহরা তাজউদ্দীন। তারপর ১৯৮১ সালে দলটি হয়ে যায় শেখ হাসিনার। ১৯৮১ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪৩ বছরের অধিককাল শেখ হাসিনা এ দেশটি ও দলটিকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপব্যবহার করেছেন। দলটির সভাপতি হয়ে তিনি শুধু পিতার স্বপ্ন ও চেতনার বাণিজ্য করে গেছেন। একসময় এ আওয়ামী লীগ তারকা রাজনৈতিক নেতা তৈরি করেছে। আর শেখ হাসিনা যখন উত্তরাধিকারসূত্রে আওয়ামী লীগের মালিকানা পেয়ে যান, তখন তিনি তৈরি করেছেন কবরী, তারানা, সুবর্ণা, মমতাজ, ফেরদৌস, পলক, আরাফাতের মতো তারকা রাজনীতিবিদ। সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার হাত ধরে হয়ে যায় কবরী, তারানা, সুবর্ণা, মমতাজ, পলক, আরাফাতের আওয়ামী লীগ।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমে ‘বাকশাল’ গঠন করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তার পুরোনো দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠনই শেখ মুজিবের জন্য কাল হয়েছিল। আর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা নিজের জীবন রক্ষা করে হত্যা করেছেন আওয়ামী লীগকে। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০২৪-এর ৫ আগস্ট কোমায় চলে যায় এবং ২০২৫ সালের ১২ মে এ রাজনৈতিক সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘোষিত হয়। দেশবাসীর ওপর শেখ হাসিনার অবর্ণনীয় অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, আত্মম্ভরিতা, দম্ভের কারণেই ৭৬ বছরের আওয়ামী লীগকে প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হতে হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, অন্যের জন্য যে পথ তিনি তৈরি করেছিলেন, সে পথেই তার দলের মৃত্যু হলো। নিষিদ্ধ হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সব সংগঠন। প্রকৃতির বিচার সবার জন্য ন্যায্যই হয়, কারও জন্য হয় অত্যন্ত নিষ্ঠুর। বিগত ১৫ বছর দেশে যাদের ক্রীতদাসের মতো করে রাখা হয়েছিল, যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, যেসব মায়ের বুক খালি হয়েছে, যারা সত্যি কথাটিও বলতে পারেননি, যাদের মানবাধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রাপ্য পরিণতিতে তারা মহান আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আনন্দে উল্লাস করেছেন। গরু জবাই করে খিচুড়িভোজের আয়োজন করেছেন। অন্যদিকে যারা প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, যাদের আদর্শ ও চিন্তার মৃত্যু হলো তারা মনে করতেই পারেন যে তাদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে। তবে মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি এমন এক ন্যায়নিষ্ঠ বিচারক, যে প্রত্যেক মানুষকেই তার কর্মফলের প্রাপ্তিটা কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়। দেরিতে হলেও প্রকৃতি কারও প্রাপ্য বাকি রাখে না। প্রকৃতি কারও প্রতি অবিচারও করে না।
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে ভারত থেকে দেশে ফিরেছিলেন পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যার প্রতিশোধের চিন্তা মাথায় নিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রথম সুবিধাভোগী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও শেখ মুজিবের অন্যতম বিশ্বস্ত সহচর খন্দকার মোশতাক আহমদ। কারণ তিনিই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তদানীন্তন তিন বাহিনী প্রধানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তার সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিলেন। অথচ ১৫ আগস্টের ঘটনার জন্য শেখ হাসিনার হিংস্র আক্রোশ ছিল স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ওপর। শেখ হাসিনা ভারত থেকে ঢাকায় ফেরার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জিয়াকে চট্টগ্রামে নিহত হতে হয়। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার নেপথ্যে শেখ হাসিনার কূটচাল থাকতে পারে, যা নিয়ে গবেষণা করলে সত্যতা পাওয়া যাবে। এ আক্রোশের কারণ ছিল জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যা তার পিতা করতে পারেননি। জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, শেখ পরিবারের কারও পক্ষেই সে গৌরব অর্জন সম্ভব হয়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি সে আক্রোশ শুধু শেখ হাসিনার ছিল না, ভিতরে ভিতরে শেখ মুজিবও ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে ভাগ বসিয়েছেন। সেটা শেখ মুজিব মেনে নিতে পারেননি। জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো না কোনো সময় শেখ মুজিবের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ এবং ইতিহাস জিয়াকে সঠিক স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে; এটা শেখ মুজিব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও জিয়াকে বাদ দিয়ে শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। জিয়াউর রহমানকে করেছিলেন উপপ্রধান।
প্রতিহিংসার নিখুঁত ছক এঁকেই রাজনীতির পথে অগ্রসর হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দল সুসংগঠিত করেন। দলের ভিত মজবুত করেন। সামরিক-বেসামরিক সকল পর্যায়ে নিজের লোক তৈরি করেন। দলকে অর্থনৈতিকভাবে মজবুত করতে গড়ে তোলেন একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে নিজের মধ্যে সুপ্ত থাকা প্রতিহিংসার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেন। তৈরি করেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূল করার মাস্টারপ্ল্যান। সে প্ল্যান অনুযায়ী তিনি চলেছেন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত। হাজার হাজার মানুষ খুন করেছেন। তার হিংস্র থাবায় আহত অনেকেই এখনো হাসপাতালের বিছানায়। বুখারি শরিফের ৪৬৮৬ নম্বর হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ জালিমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে তাকে এমনভাবে পাকড়াও করেন, সে আর ছুটে যেতে পারে না।’ মহান আল্লাহ বান্দার কৃতকর্মের বিচার দুুনিয়াতেই করে থাকেন। রসুল (সা.) হাদিসে কুদসিতে (মুসলিম : ৬৭৩৭) আল্লাহর কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অন্যের ওপর জুলুম কোরো না।’ অতএব প্রকৃতির বিচারে মজলুমের ওপর জুলুমের নিষ্ঠুর পরিণতিই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা বুুঝিয়ে দিয়েছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। সরকারের বয়স এখন নয় মাস। সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে কোনোরকমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ এখনো ট্রমা কাটিয়ে ভাবমূর্তি ও পেশাদারি দৃঢ়তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর জন্য রেমিট্যান্সই অন্যতম ভরসা। নানান শর্তে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। দেশের উচ্চবিত্তরা এখন পর্যবেক্ষণে আছেন। ভালো নেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা। খাবারে টান পড়ছে খেটে খাওয়া মানুষের। বেকারত্ব দিনদিন বাড়ছে। রাজনীতির পুবাকাশ এখনো স্বচ্ছ হয়নি। সংস্কার, ঐকমত্য কিছুতেই এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। এর মধ্যে আবার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় সংগীত নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে সরকারকে ব্যর্থ করতে ভিতরে-বাইরে ভূরাজনীতির অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা চুপচাপ বসে নেই। তারা একের পর এক মতলবি কলকাঠি নেড়েই চলেছে। দেশে সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমী জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা যত বেশি বিলম্বিত হবে, খেলোয়াড়দের খেলার পরিবেশ তত বেশি অনুকূলে থাকবে। পানি ঘোলা করে মাছ ধরার জন্য তক্কে তক্কে থাকবে তারা। সুতরাং আওয়ামী লীগের মৃত্যু হয়েছে, তাতে এখনই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে লাভ নেই।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন