প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের হৃৎপিণ্ড উল্লেখ করে বলেছেন, এ বন্দর হলো আমাদের ভরসা। দেশের অর্থনীতি পাল্টাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরকে পাল্টাতে হবে। এটাকে বাদ দিয়ে দেশের অর্থনীতির নতুন কোনো পাতা, নতুন কোনো অধ্যায়ে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। এ বন্দর পথ খুলে দিলে দেশের অর্থনীতির পথ খোলে। এ বন্দর পথ না খুললে যতই লাফালাফি করা হোক, কিছুই হবে না। উন্নয়নের স্বার্থে বন্দর ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর সেরা যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের নিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-৫ এ একটি সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। আরও বক্তব্য রাখেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান। বন্দরে সভা শেষে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এখানে জলাবদ্ধতা নিরসন ও সড়ক উন্নয়নসংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের জন্য জমি বরাদ্দের দলিল হস্তান্তর করেন। দুপুরে তিনি সার্কিট হাউস থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
বন্দরে দেওয়া বক্তব্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মানুষ যদি রাজি না থাকে, তাদের রাজি করাতে হবে। মানুষকে গররাজি করে করানোর দরকার নেই। রাজি করিয়েই করতে হবে। এটা এমন একটা বিষয় পুরো জিনিসটা শুনলে গররাজি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সবাই চায় তার ভালো হোক। না বোঝার কারণে বলছে যে আমার এই ক্ষতি হবে, এটা হলে ভালো হবে না, এটাতো আমাদের ছিল, ওকে কেন দিচ্ছেন। যখন দেখবে যে না এটা সবার জন্য ভালো হবে তখন বলবে আপত্তি নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, যদি হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয় ডাক্তার বৈদ্য সবকিছু আনো, মেরামত হবে কিন্তু চলবে না। ছোট্ট একটা হৃৎপিণ্ড, তার মধ্যে রোগাক্রান্ত, এটাকে তুমি যতই চেষ্টা করো রক্তসঞ্চালন হবে না। এটা যদি আমরা একমত হই যে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর, তাহলে যে আকারের হৃৎপিণ্ড আছে, বন্দর আছে -তা দিয়ে হবে না। এই হৃৎপিণ্ড বিশ্ব আকারের হতে হবে। তাহলে এটার স্পন্দন হবে। অর্থনীতি সচল হবে তার নালি দিয়ে ওপরের দিকে যাবে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে যাবে। সারা দেশের জিনিস এখান দিয়ে বিদেশে যাবে। এটাই হলো হৃৎপিণ্ডের কাজ, বন্দরের কাজ। বন্দর আরও আছে, কিন্তু এটা হলো কেন্দ্রীয়, সবচেয়ে বড়। এখান থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা বললাম যে পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে তাদের ডাকো। দেখলাম আগেই ডাকা হয়ে গেছে কিন্তু কাজটা হচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি এটা তাড়াতাড়ি করতে হবে। যত দিন যাবে আমরা এ হৃৎপিণ্ডকে আর স্থাপন করতে পারব না। আমাদের যে সুযোগ আছে এ সুযোগে আমরা হৃৎপিণ্ডকে ওই সাইজে, যেই সাইজে আমরা কল্পনা করি বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়াবে, ভবিষ্যৎ পরিবর্তন হয়ে যাবে, এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশে কোনো অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলো সংযুক্ত হলে উভয় পক্ষই লাভবান হবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড নয়, আশপাশের দেশের সঙ্গেও সংযুক্ত। নেপাল, ভুটান ও সেভেন সিস্টার্স-সবার জন্য হৃৎপিণ্ড এই একটাই। নেপালের জন্য কোনো হৃৎপিণ্ডই নেই। আমাদের হৃৎপিণ্ড দিয়ে তাকে জ্বালতে হবে। আমরা তাকে সংযুক্ত করতে চাই। এটা কোনো মেহেরবানি নয়। এতে আমাদেরও লাভ, তাদেরও লাভ। হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে ভুটান যদি সংযুক্ত হয়, সেও লাভবান হবে, আমরাও লাভবান হব। সেভেন সিস্টার্স যদি সংযুক্ত হয় তারাও লাভবান হবে, আমরাও লাভবান হব। এ হৃদপিণ্ডকে বাদ দিয়ে চললে, যারা বাদ দেবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রক্তসঞ্চালন হবে না সেখানে, অর্থনীতি সঞ্চালন হবে না। এটা আমাদের কারও কাম্য নয়। তাদেরও কাম্য নয়। আমরা চাই সবাই মিলে যেন বন্দর থেকে এ সঞ্চালনটা পাই। শক্তিটা পাই। অর্থনৈতিক শক্তি জেগে উঠুক।
বন্দরের উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমরা একটা বন্দর ও কয়েকটা টার্মিনাল নিয়ে কথা বলছি। কোনো কোনো দেশে ২০-৩০টি বিশ্বমানের বন্দরও আছে। বিশ্ব সাইজের বন্দর এগুলো। সেখান থেকে তাকালে আমাদেরকে খুব ক্ষীণ মনে হয়। এই হৃৎপিণ্ড দিয়ে তো রোগী বেশিদিন টেকানো যাবে না। তাই এটাকে শক্তিশালী করতে হবে। ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী করতে হবে। একবার শক্তিশালী করে সেখানে ইতি টানলে চলবে না। সেখানেই আছে আমাদের চ্যালেঞ্জ।
বন্দর বিদেশিদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে কেউ কেউ যে প্রশ্ন তুলছেন সে প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বন্দরের চিকিৎসা দরকার। বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনতে হবে। উপায় নেই আমাদের। সবচেয়ে সেরা চিকিৎসকের হাতে ছেড়ে দিতে হবে যাতে করে এই হৃৎপিণ্ড বিরাট আকারে আমাদের বানিয়ে দিতে পারে। কোনো সমস্যা যেন আমাদের না হয়। এই হৃৎপিণ্ড ক্রমাগত মজবুত হবে, শক্তিশালী ও বৃহত্তর হবে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, অনেক জাতি আমাদের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কাজেই বড় চিকিৎসক দিয়ে কাজ করাতে হবে। এতে আমাদের লাভ। একটা লাভ হলো এর পেছনে আমাদের কোনো টাকা-পয়সা খরচ হচ্ছে না। বিল্ড, অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার। তোমরা বানাও, তোমরা পরিচালনা করো, মেয়াদ শেষে আমাদের দিয়ে দিতে হবে। তারা দুনিয়াতে শত শত পোর্ট পরিচালনা করে। যাদের কথা আমরা বলছি, যাদের সঙ্গ আমরা কাজ করছি তারা দুনিয়ার সেরা। তারা আমাদের মতো বানাবে না, তাদের মতো করে তৈরি করবে। সেরা প্রযুক্তি দিয়ে বানাবে। সর্বশেষ অভিজ্ঞতা এখানে আনবে। আমাদের টকা লাগল না, অভিজ্ঞতাও লাগল না। হাহা করে চাকরি চলে গেল। ওরা লোাক আনবে না ওদের দেশ থেকে। আমাদের লোকজন দিয়ে চালাতে হবে। যদি ২০৩১ সালে চালু হয় পরের পাঁচ বছরে বাংলাদেশের লোকজনের যে অভিজ্ঞতা হবে তা দিয়ে বিশ্বের বন্দরগুলো বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে। আমরা চাই তাড়াতাড়ি বিনিয়োগ হোক। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত চুক্তি সই করতে হবে, কাজ শুরু করতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর অপেক্ষার সুযোগ নেই। বন্দর ব্যবসায় বাংলাদেশ বিশ্বে স্থান করে নেবে।
কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন : চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর বহুল প্রত্যাশিত রেলসহ সড়কসেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল চট্টগ্রামের সার্কিট হাউস থেকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ফলক উন্মোচন করেন তিনি।
উদ্বোধন ঘোষণা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কালুরঘাট ব্রিজে আমার অনেক স্মৃতি। এই সেতুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। আজ এখানে বোয়ালখালীর বাসিন্দাও উপস্থিত আছেন। কালুরঘাট সেতু তাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত। এটি তৈরি হয়ে গেলে চট্টগ্রামবাসীর বহু কষ্টের অবসান হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন একটি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ। নতুন সেতুর কাজ ২০২৯ সালের মধ্যে শেষ করে ২০৩০ সালে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা কমাতে নির্দেশনা : চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে আগের তুলনায় অর্ধেকে এবং ক্রমান্বয়ে শূন্যে নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং অক্সিজেন-হাটহাজারী মহাসড়কের উন্নয়নসংক্রান্ত বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ নির্দেশনা দেন।
এ সময় তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নানা উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতার কথা শোনেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা অনেক রকম থিওরিটিক্যাল আলোচনা করেছি, সেসব আর করতে চাই না। আমরা চাই জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে চিরতরে বের হয়ে আসতে। কিন্তু সেটা একবারেই হবে না, তাই আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, এ বছর যেহেতু বর্ষা মৌসুম ইতোমধ্যে এসে গেছে তাই এবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না। কয়েক মাসে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাতে যদি আশানুরূপ ফল না আসে তাহলে তো সবকিছু মনে হবে জলে গেল। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক অর্জনের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে একটি প্রতীকী সমস্যা এবং খুবই জটিল সমস্যা। এ সমস্যা নিরসনের মাধ্যমে অন্যান্য শহর ও জেলা উৎসাহিত হবে, তাই চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। এ সমস্যা নিরসনে নিয়মিত তাগিদ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরের যে সক্ষমতা রয়েছে অন্য অনেক অনেক শহরের সেই সক্ষমতা নেই। তাই চট্টগ্রামের সব প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে হবে এবং নাগরিক সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে।
সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, প্রধান উপদেষ্টার স্পেশাল এনভয় লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ প্রমুখ।