ইতিহাস থেকে জানা যায় ইসলাম আগমনের আগে আরবীয়রা উট ও ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি তাঁবুতে বসবাস করতেন। ইসলামের আবির্ভাবের পর আরব স্থাপত্যে নতুন যুগের সূচনা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন পবিত্র ও ধ্রæপদি এক সভ্যতার জনক। মানুষের কল্যাণের পথে প্রতিটি পদে পদে তিনি আলোর মশাল জ্বালিয়েছেন। এঁকেছেন এক নতুন পৃথিবীর মানচিত্র। বিশ্বজুড়ে প্রাচীন কিছু মুসলিম ঐতিহ্যের শহর নিয়ে আজকের রকমারি...
মুসলমানদের পবিত্রতম নগরী মক্কা
মক্কা নগরীকে বলা হয় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্রতম নগরী। ইসলামের ইতিহাসের সূচনালগ্নে এই শহরটির নাম জড়িয়ে আছে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। এই শহরে মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম এবং এখানেই তিনি কোরআনের প্রথম ওহি লাভ করেন। (বিশেষভাবে, হেরা গুহায় যা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে)। এখানেই পবিত্র কাবা শরিফ অবস্থিত। মুসলমানরা প্রতি বছর হজ ও ওমরাহ পালনের জন্য এখানে আসেন। মক্কার প্রাণকেন্দ্র এই কাবা শরিফ ঘিরেই গড়ে উঠেছে শহরটি। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী কাবা হলো মুসলমানদের কেবলা। মুসলমানরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের সময় এই কাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখেন। এটি মুসলমানদের প্রার্থনার দিকনির্দেশ করে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই শহর মুসলমানরাই শাসন করে আসছে। ১৯২৫ সালে বাদশাহ ইবনে সৌদ সৌদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর থেকে সৌদ বংশ মক্কার দায়িত্ব পালন করে আসছে। আধুনিক যুগে এসে শহর বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, নাগরিক সুবিধা ইত্যাদির। বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম ভবন মক্কা রয়েল ক্লক টাওয়ার এই শহরেই অবস্থিত। উক্ত ভবনের মেঝের আয়তন সারা বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। শহর সম্প্রসারণের কারণে অনেক ঐতিহাসিক কাঠামো এবং প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শন, যেমন আজিয়াদ দুর্গ হারিয়ে গেছে। প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন মুসলমান মক্কা শহর ভ্রমণ করেন। ফলশ্রুতিতে শহরটি সারা বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিশ্বজনীন শহরে পরিণত হয়েছে। গোটা বিশ্ব থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এখানে আসেন সারা বছরই।
স্পেনের শেষ মুসলিম সাম্রাজ্য গ্রানাডা
স্পেনের শেষ মুসলিম সাম্রাজ্য গ্রানাডা। ১১০০ শতকের শুরুর দিকে স্পেনে মুসলমানদের জয়গাথা স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। এক সময় শেষ মুসলিম সাম্রাজ্য হিসেবে গ্রানাডাই টিকে ছিল। রিকনকুইস্তার সময় আল-আন্দালুসিয়ার উত্তর দিক থেকে আসা হানাদার খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর হাতে একের পর এক মুসলিম রাজ্যগুলোর পতন হতে থাকে। কর্ডোভা, সেভিয়া এবং টলেডোর মতো বড় বড় শহরগুলোর পতন হয় ১১০০ থেকে ১৩০০ শতকের মধ্যে। একটিমাত্র মুসলিম রাজ্য গ্রানাডা ১৩০০ শতকে খ্রিস্টানদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোভার পতনের পর গ্রানাডা আমিরাতের শাসকরা শক্তিশালী খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের সঙ্গে এক বিশেষ চুক্তিস্বাক্ষর করেন। অর্থাৎ তারা ‘গ্রানাডা আমিরাত’ হিসেবে স্বাধীন থাকার অনুমতি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ক্যাস্টিল সাম্রাজ্যের আক্রমণের মুখোমুখি না হওয়ার শর্তে ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের কাছে কর প্রদান করতে হয়েছিল। এ কর প্রদান করতে হতো প্রতি বছর স্বর্ণমুদ্রা হিসেবে। এ ছাড়া গ্রানাডা আমিরাতের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকার পেছনে অন্য কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। গ্রানাডা দক্ষিণ স্পেনের সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার মধ্যে অনেক উঁচু স্থানে অবস্থিত, যা আক্রমণকারী বহিঃশক্তির জন্য অনেক কঠিন ছিল। এ প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা গ্রানাডার জন্য শক্তি হিসেবে কাজ করত। এ কারণে খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের চেয়ে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এ প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা গ্রানাডাকে দিয়েছিল আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে বিশাল এক সুবিধা। প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্রানাডা টিকে ছিল স্পেনের শেষ মুসলিম রাজ্য হয়ে।
চীনের মসজিদের শহর ছিল সুজু
চীনে ইসলামের ইতিহাস অনেক পুরনো। টাং রাজবংশের শাসনামলে চীনে ইসলাম প্রবেশ করে। তবে চীনে ইসলাম আগমনের সঠিক সময় নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, মুহাম্মদ (সা.) এর জীবদ্দশায় ৬২০ খ্রিস্টাব্দে চীনে ইসলাম প্রবেশ করে। বলা হয়ে থাকে চীনের হারিয়ে যাওয়া মসজিদের শহর সুজু। চীনের এই বিখ্যাত বাণিজ্যিক নগর সুজু শহর খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতাব্দীতে স্থাপিত হয়েছিল। দেশটির পূর্বাঞ্চল সাংহাইয়ের পার্শ্ববর্তী জিয়াংসু প্রদেশে অবস্থিত এশিয়ার দীর্ঘতম ইয়াংজির নদী। এর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে সুজু শহর। অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক নদ-নদী আর ঝরনায় ভরপুর এই শহর। এর নান্দনিক দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে ঘুরতে আসেন বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকরা। প্রাচীন সুজু শহরে এখন ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। সাংহাই থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে আসতে মাত্র ২০ মিনিটের পথ। এক সময়ের মুসলমানদের শহর হিসেবে পরিচিত সুজু শহরে এখন কেবল একটি মাত্র মসজিদ বিদ্যমান। অথচ একটা সময় এই শহর ছিল মসজিদে পরিপূর্ণ। বিভিন্ন পাথরের ফলক, সম্রাটদের নথি ও লিখিত দলিল থেকে বোঝা যায়, তৎকালীন মুসলিমরা চীনা রাজবংশের সম্রাটদের শাসনকাল দেখেছেন। বিশেষত তাং রাজবংশ, ইউয়ান রাজবংশ, মিং রাজবংশ, কিন রাজবংশ ইসলামের প্রতিনিধিদের অত্যন্ত সম্মান করতেন। ইসলামের নৈতিক শিক্ষার প্রভাবে সম্রাটরা মুসলমানদের শ্রদ্ধা করতেন। তাছাড়া সাম্রাজ্যে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাস তাদের পছন্দনীয় ছিল।
ইস্তাম্বুল ছিল অনেক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের রাজধানী
ইস্তাম্বুল বিশ্বের একমাত্র নগরী যেটি একই সঙ্গে দুটি মহাদেশের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। এটি তুরস্কের উত্তর-পশ্চিম ভাগে অবস্থিত বৃহত্তম নগরী ও প্রধান সমুদ্রবন্দর। আঙ্কারা শহরটি তুরস্কের প্রশাসনিক রাজধানী হলেও ইস্তাম্বুল আজও দেশটির ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। এটি প্রাচীনকালে বাইজেন্টাইন ও কনস্টান্টিনোপল নামে পরিচিত ছিল। এই ঐতিহাসিক নগরীটি ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশকে পৃথককারী এবং কৃষ্ণ সাগর ও মারমারা সাগরকে সংযুক্তকারী সরু বসফরাস প্রণালিটির পূর্ব ও পশ্চিম অংশ জুড়ে অবস্থিত। ইস্তাম্বুল প্রায় ১৬ শতক ধরে ধারাবাহিকভাবে অনেক শক্তিধর সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তার মধ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্য (১৪৫২-১৯২২) ছিল অন্যতম। এ সময় এখানে মুসলমানদের নগরী হয়ে ওঠে। এই শহরে রয়েছে বহু ইসলামিক নিদর্শন। বর্তমানে ইস্তাম্বুলে ১ কোটি ৫০ লাখেরও অধিক অধিবাসীর বাস যা তুরস্কের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। শহরের ঐতিহাসিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রসহ দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর বাসস্থান ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত।
ঐতিহাসিক নগরী সাবতা
মরক্কোর ঐতিহাসিক নগরী সাবতা। বর্তমান নাম সিউটা। ছয় শতাব্দীকাল ধরে সাবতায় স্পেনের উপনিবেশ। স্পেনীয়রা এর নাম বদলে রাখে সিউটা। মরক্কোর দেশীয় মিডিয়াগুলো এই উপনিবেশকে স্পেনীয় ছিটমহল বলে প্রচার করে। মরক্কোর অবিচ্ছেদ্য অংশ সাবতার ইতিহাস কোনোক্রমেই মুসলিম আন্দালুস ও মরক্কোর ইতিহাস থেকে ভিন্ন নয়। মুসলিম শাসনামলে সাবতা অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী ছিল। এতে ছিল সহস্রাধিক মসজিদ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগদ্বিখ্যাত অনেক মহাবিদ্যালয়। আর সমৃদ্ধ বহু সংখ্যক পাঠাগার। এখন যদিও পুরো শহরটিতে মাত্র পাঁচটি মসজিদ রয়েছে। ইসলামী স্থাপত্য বলতে আট দশক আগের মাওলা আল-মাহদি মসজিদ, রাজকীয় নগরপ্রাচীর আর কিছু জীর্ণ দুর্গ ও গোসলখানা অবশিষ্ট রয়েছে। এগুলোও বর্তমানে অযত্নে-অনাদরে ধ্বংসপ্রায়। মুরাবিত, মুওয়াহহিদ ও আলমারিনিরা এটি শাসন করেছে শত শত বছর। একসময় আন্দালুসে মুসলিম শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে ১৪১৫ সালে পর্তুগিজরা শহরটি দখলে নিয়ে নেয়।
ইরাকের শহর কুফা
হজরত উমর (রা.) এর খিলাফতের সময় কুফানগরীর গোড়াপত্তন হয়। কুফা বর্তমান ইরাকের একটি শহর। শহরটি বাগদাদ হতে ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং নাজাফ হতে ১০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত। ২০০৩ সালে শহরটির আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। সামাররা, কারবালা, খাদিমিয়া, নাজাফ এই চারটি ইরাকি শহরের সঙ্গে কুফা শহরটিও শিয়া মুসলিমদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। উমর (রা.)-এর খিলাফতের সময় এ শহরটি গড়ে ওঠে। এই নগরী ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর রাজধানী। এ শহরে রয়েছে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত ইসলামের প্রারম্ভিক কালের একটি মসজিদ। যা মসজিদ আল-কুফা নামে পরিচিত।