বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

গণমাধ্যম ও পুলিশ

ড. হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক আইজিপি ও রাষ্ট্রদূত

গণমাধ্যম ও পুলিশ

দেশ ও মানুষের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে অত্যাবশ্যক গণতন্ত্রের সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও সবল বিকাশের পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বায়নের এ যুগে সমাজজীবনে গণমাধ্যম আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ভূমিকা উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই।  প্রসঙ্গত, টমাস জেফারসনের বিখ্যাত উক্তিটি উল্লেখ করা যেতে পারে : সংবাদপত্রবিহীন সরকার না সরকারবিহীন সংবাদপত্র কাম্য? সরকারবিহীন সংবাদপত্র সমাজের জন্য শ্রেয়তর বলে মতামত দেওয়া হয়েছিল। কোনো কোনো বিদ্বজ্জনের কাছে জেফারসনের মন্তব্যটি অতিশয়োক্তি হতে পারে; তবে মন্তব্যটির মাধ্যমে সংবাদপত্রের গুরুত্ব যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে।  সংবাদপত্র আরও বৃহত্তর অর্থে গণমাধ্যম অগ্রসরমান অনেক দেশের মতো আমাদের সমাজেও সামাজিক দর্পণ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে সংবাদপত্রকে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে একই কাঠামোতে বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী মুঘল-ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের আদলে শাসকশ্রেণির কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পুলিশ বাহিনী নতুন আদর্শে ও লক্ষ্যে প্রতিভাত হয়। সেখানে কায়েমি স্বার্থের পরিবর্তে জনকল্যাণ সর্বাগ্রে বিবেচিত হয়। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম পুলিশ সপ্তাহের বার্ষিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু সংগত কারণে ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশের পুলিশ হবে গণমুখী পুলিশ। এই নীতিনির্ধারণী ঘোষণার ধারাবাহিকতায় পুলিশ বাহিনীর আদর্শিক অবস্থান ফোর্স থেকে সেবায় রূপান্তরিত হয়। এ কারণে বাংলাদেশ পুলিশকে জনকল্যাণে নিবেদিত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করতে হবে। অতএব, আমাদের সমাজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে গণমাধ্যম ও পুলিশ জনসেবার অভিন্ন লক্ষ্যে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োজিত হয়ে দায়িত্ব পালন করবে বলে প্রত্যাশা করা হয়। দায়িত্ব পালনে বৈশিষ্ট্য ও কৌশলগত ভিন্নতা থাকলেও জনসেবার অভিন্ন লক্ষ্য এই দুই প্রতিষ্ঠানকে শুধু যুথবদ্ধ করেনি বরং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে চিহ্নিত ও সক্রিয় করেছে।

জনমনে পুলিশ ও গণমাধ্যম সম্পর্কের ব্যাপারে একটি প্রচলিত ধারণা প্রায়শ দেখা যায়। এটা মাঝে মাঝে চোর-পুলিশ, অনেক সময় ইঁদুর-বিড়াল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদায়-কাঁচকলায় হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এ ধরনের সম্পর্ক কিংবা মানসিকতা অনভিপ্রেত। তবে সংগত কারণে অনেক সময় গণমাধ্যমকে তথ্য অথবা মন্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে রক্ষণশীল কিংবা অতিরিক্ত সাবধানী হতে দেখা যায়, যা পরবর্তীতে অনেক সময় অসহযোগিতা কিংবা অসৌজন্য বলে মনে করা হয়। পুলিশের এই ঢাক ঢাক গুড় গুড় অবস্থানকে পেশাদারি দৃষ্টিকোণ ও যুক্তির নিরিখে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু তদন্ত, কার্যকর অনুসন্ধান কিংবা বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক বিষয় প্রকাশ করা যায় না; পুলিশের এই অনুপেক্ষণীয় সীমাবদ্ধতাকে পেশাদারি, উদার ও মাঝে মাঝে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে দেখলে অনেক সন্দেহ, অসন্তোষ, বিতর্ক বা হতাশা থেকে গণমাধ্যম স্বস্তি পাবে।

গণমাধ্যম ও পুলিশ উভয় প্রতিষ্ঠানেরই কাজের বৈশিষ্ট্য কষ্টসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ, জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। গণমাধ্যম কর্মী তার প্রতিবেদনের মাধ্যমে যেমন সত্য উপস্থাপন করেন তেমনি পুলিশ কর্মকর্তা তার অনুসন্ধান, তদন্ত ও আভিযানিক তৎপরতার মাধ্যমে সত্যানুসন্ধান করে বিচারের জন্য পেশ করেন। এ ক্ষেত্রে কর্ম বৈশিষ্ট্যের সাযুজ্যের কারণে গণমাধ্যম ও পুলিশ উভয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য, বোঝাপড়া সর্বোপরি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার নিরাপোস অঙ্গীকার কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন সহজতর, কার্যকর ও ফলপ্রসূ করবে। বস্তুতপক্ষে উভয়পক্ষ যদি সত্য প্রতিষ্ঠায় যুগপৎ অঙ্গীকারবদ্ধ হয় তাহলে প্রতিবন্ধকতা কিংবা সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে দায়িত্ব পালনে অদক্ষতা, অসততা, আপসকামিতা, অপেশাদারিত্ব, নিষ্ঠার অভাব থাকলে সেক্ষেত্রে বিতর্ক, বিদ্বেষ ও ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার সমূহসম্ভাবনা থাকে। গণমাধ্যম ও পুলিশ উভয়ই দায়িত্ব পালনকালে প্রাসঙ্গিক করণীয়-বর্জনীয় দিকগুলোর ব্যাপারে সতর্ক এবং নিষ্ঠাবান হলে সমস্যা সমাধান ও প্রতিবন্ধকতা উত্তরণ অনেক সহজ হয়।

পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কর্মজীবনের প্রায় ৩৬ বছর অতিবাহিত করার সুযোগ হয়েছে। বলাবাহুল্য, এ সময় অনেক প্রীতিকর, ভীতিকর ও কৌতূহলোদ্দীপক অভিজ্ঞতা হয়েছে। ২০০৯ সালে পুলিশে দায়িত্ব পালনকালে একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধানের সঙ্গে আলাপচারিতা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক মনে করছি। স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠে তিনি একদিন অনুযোগ করলেন আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মিডিয়া বা গণমাধ্যমে কেন ঘন ঘন কথা বলি; টিভিতে কেন আলোচনায় অংশগ্রহণ করি। তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যুগ পাল্টেছে, ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে; বাংলাদেশে পুলিশ এখন আইউব খান আমলের দমন-পীড়নের হাতিয়ার নয়; পুলিশ এখন ফোর্স থেকে রূপান্তরিত হয়ে জনকল্যাণে নিবেদিত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশে পুলিশ আর এখন ফোর্স নয়; পুলিশ এখন সার্ভিস বা সেবা। এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, সেবা প্রদানের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার বিশ্বাস, আস্থা আর ভালোবাসা অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। গণমাধ্যম যদি যথাযথভাবে পুলিশের ইতিবাচক ভূমিকা ও কার্যক্রমকে সেবাগ্রহীতাদের অর্থাৎ নাগরিকদের কাছে তুলে ধরে তবে প্রত্যাশিত আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা অর্জন সহজতর হয়। আমার মতামতে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান খুব একটা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। অবসরপ্রাপ্ত সম্মানিত পুলিশ প্রধানকে দোষারোপ করতে চাই না। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেওয়া এই বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সম্ভবত আইউব খানের ১৯৬০ সালের প্রেস আইনের আলোকে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন উল্লিখিত আইনবলে সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো কিছু ছাপানো প্রায় অসম্ভব ছিল। পাকিস্তানে পুলিশ তখন শক্তি প্রয়োগের হাতিয়ার বা ফোর্স ছিল; সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের মতো জবাবদিহিতার মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি পুলিশকে গ্রাহ্য করতে হতো না। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে একই ধরনের আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর। নতুন কর্মস্থলে যাওয়ার আগে মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষাকৃত কম বয়সের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপের সময় কিছু পরামর্শ চাইলাম। সদালাপী পেশাদার কূটনীতিক কর্মকর্তা বেশ কয়েকটি ভালো পরামর্শ দিলেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। তবে একটা পরামর্শ হৃষ্টচিত্তে নিতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন, মিশনে স্বস্তি নিয়ে কাজ করতে হলে কমিউনিটি থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। পরবর্তীতে নতুন কর্মস্থলে উল্টো কৌশল নিয়েছিলাম অর্থাৎ কমিউনিটির সদস্যদের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে তাদের সঙ্গে নিয়মিত ও নিবিড় সম্পর্ক রেখে শুধু স্বস্তিতে ছিলাম না বরং এই সম্পৃক্ততা ও সৌহার্দ্য মিশনের সার্বিক লক্ষ্য অর্জনে অন্যতম অনুঘটক হয়ে কাজ করে। আসলে অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা তথাকথিত আমলাতান্ত্রিক বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে এসে মনের অর্গল উন্মুক্ত করে জনস্বার্থ ও জনসেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে মাঝে মাঝে দ্বিধান্বিত হই। পরিবর্তিত রাষ্ট্রীয় ও বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের রক্ষণশীলতা ও জড়তা থেকে আমাদের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের নির্বাহীদের মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। তাদের অগ্রসরমান ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল। এ কারণে চলমান রাষ্ট্রীয় ও বৈশি^ক বাস্তবতায় গণমাধ্যম ও পুলিশের সম্পর্ক আরও নিবিড়, গতিশীল ও কার্যকর হবে বলে আমি আশাবাদী।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার গুরুদায়িত্ব যুগপৎ পুলিশ ও গণমাধ্যমের ওপর বহুলাংশে পড়েছে। সংক্ষেপে চ্যালেঞ্জগুলো হলো : সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ, মাদকের করাল গ্রাস, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নীরব ও সরব অপতৎপরতা এবং সাইবার অপরাধ। এগুলো কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য সুদৃঢ় জাতীয় ঐকমত্য ও সংহতির প্রয়োজন। উপরন্তু চ্যালেঞ্জগুলো মূলত ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও সত্যানুসন্ধানের দায়িত্ব পুলিশের। এই গুরুদায়িত্ব পালনে পুলিশের অঙ্গীকার ও সক্ষমতা আছে বলে আমার বিশ্বাস। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম পুলিশের সঙ্গে সহযোগী শক্তি হিসেবে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করলে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা অনেকটা সহজ ও কার্যকর হবে।  গণমাধ্যম তথ্য, গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে পুলিশি কার্যক্রমকে সঠিক দিক নির্ণয়ে সহায়তা করতে পারে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণমাধ্যমের একটি শক্তিশালী অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য, সোশ্যাল মিডিয়া যেমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে তেমনি এর নেতিবাচক ব্যবহার অনেক সময় সমাজকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলছে।  বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব এ আশীর্বাদ যেন কোনোভাবেই সমাজবিধ্বংসী অভিশাপে পরিণত না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মী ও পুলিশকে সচেতন থাকতে হবে। আশার কথা, সোশ্যাল মিডিয়াতে অসংখ্য প্রাজ্ঞ, প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক ব্যবহারকারী সম্পৃক্ত আছেন।  সমাজকে অপরাধমুক্ত করার মানসে পুলিশের পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে তারাও ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন। 

দেশটা আমাদের। একে রক্ষা ও গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার।  আশা করি আর সবার সঙ্গে গণমাধ্যম ও পুলিশ সম্মিলিতভাবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে অভীষ্ট লক্ষ্যে  পৌঁছতে পারবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর