জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া মারধরের পর 'নকল মাদকদ্রব্য' দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কাছে তুলে দেওয়ার অভিযোগও করেন ওই ব্যক্তি।
গত রবিবার দিবাগত রাত নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙামাটি এলাকা থেকে তাকে তুলে আনা হয়।
অভিযুক্তরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ, এহসান ইমাম নাঈম ও সাজ্জাদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান জয়, অর্থ সম্পাদক মো. তৌহিদুল ইসলাম তাকীদ এবং উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আলরাজী সরকার।
অন্যদিকে ভূক্তভোগী ফরিদ হোসেন ওরফে পাঞ্চু বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাঙামাটি এলাকার বাসিন্দা। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাউজিং সোসাইটিতে (অরুনাপল্লি) নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রবিবার রাত নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা রাঙামাটি এলাকায় গিয়ে ফরিদ হোসেনকে মারধর শুরু করেন। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ফরিদকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন তার পরিবার। তখন ফরিদকে রিকশায় তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে নিয়ে আসেন ছাত্রলীগ নেতারা। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফরিদের পরিবারের কাছে অজ্ঞাত পরিচয়ে ফোন দিয়ে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তবে শেষে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে ফরিদকে ছাড়তে রাজি হন তারা।
এরপর রাত দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন গেরুয়া বাজারে গিয়ে ছাত্রলীগের দুই নেতার কাছে ৫০ হাজার টাকা হস্তান্তর করেন আপেল মাহমুদ নামে ফরিদের পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তি। পরে সোমবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে এহসান ইমাম নাঈম একজন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরা হয়েছে বলে কল করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হল সংলগ্ন সুইজারল্যান্ড এলাকা থেকে ওই ব্যক্তিকে নিয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা।
এর আগে, গত ৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে ফরিদের মাথা ফাটিয়ে দেন সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয়। এছাড়া তখন ফরিদের সঙ্গে থাকা টাকাগুলোও ছিনিয়ে নেন তারা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদ হোসেন বলেন, 'চারজন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইজারল্যান্ড এলাকায় নিয়ে গিয়ে মারধর করে। পরে আমার পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। তাদের মধ্যে, সাজ্জাদ হোসেন, মো. তৌহিদুল ইসলাম তাকীদ ও আলরাজী সরকারকে চিনতে পেরেছি। বাকি একজনকে চিনতে পারিনি। এছাড়া ফোনে সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয়ের সাথে বারবার যোগাযোগ করছিলো তারা। এরপর ভোরে কিছু নকল ইয়াবা ও ফেন্সিডিলের বোতলে পানি ভরে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কাছে ধরিয়ে দেয়। আমি কোনো মাদক ব্যবসায়ী নই।'
ফরিদ হোসেনের স্ত্রী শিরিন আক্তার বলেন, 'আমার স্বামী মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রলীগের নেতা আমার স্বামীকে মাদক ব্যবসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তবুও তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তারা আমার স্বামীকে কয়েকবার মারধর করেছে। রবিবার রাতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আমার স্বামীকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায়। আমি তাদের চিনি না। তবে সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয় যেহেতু আগে মাথা ফাটিয়েছিল, সেহেতু তাদের নির্দেশেই তুলে নিয়ে যেতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রলীগ নেতারা ফোন দিয়ে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। তবে আমরা দুই লাখ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে, তারা ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার স্বামীকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়। পরে আমাদের পরিচিত আপেল মাহমুদ ভাইয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। এরপর সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখা থেকে ফোন পাই, আমার স্বামী তাদের হেফাজতে আছেন বলে জানান তারা।'
আপেল মাহমুদ বলেন, 'ছাত্রলীগ নেতারা ফোন দিয়ে ফরিদের পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। তখন ফরিদের পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি আমাকে জানালে, আমি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে দুইজন ছাত্রলীগ নেতার কাছে দিয়ে আসি। রাতের অন্ধকারে আমি তাদের চিনতে পারিনি। তবে এহসান ইমাম নাঈম, সাব্বির হোসেন নাহিদ, মেহেদী হাসান জয়, সাজ্জাদ হোসেন, মো. তৌহিদুল ইসলাম তাকীদ ও আলরাজী সরকার জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করছি। কারণ তারা এর আগেও কয়েকবার এসে টাকা দাবি করেছিলো।'
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ ও এহসান ইমাম নাঈম, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান জয় এবং উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আলরাজী সরকার সাংবাদিকদের জানান, ‘এ ধরনের কোনো কাজে সাথে তারা জড়িত না।’ এছাড়া মো. তৌহিদুল ইসলাম তাকীদকে ফোন দেওয়া হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে বন্ধ করে রাখেন। অন্যদিকে সাজ্জাদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটনকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) জেফরুল হাসান চৌধুরী সজল বলেন, ‘ভোরে মওলানা ভাসানী হলের শিক্ষার্থী এহসান ইমাম নাঈম ফোন দিয়ে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিন স্যারকে একজন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরেছে বলে জানায়। তখন সুদীপ্ত শাহিনের নির্দেশে নিরাপত্তারক্ষী নূর এ আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হল সংলগ্ন সুইজারল্যান্ড এলাকায় গিয়ে ওই মাদক ব্যবসায়ীকে নিয়ে আসেন। পরে বিষয়টি পুলিশকে জানালে, তারা এসে মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করে তাকে নিয়ে যায়।’
নিরাপত্তারক্ষী নূর এ আলম বলেন, ‘ভোরে নিরাপত্তা শাখার নির্দেশে সুইজারল্যান্ড এলাকায় গিয়ে ফরিদকে নিয়ে আসি। তখন ফরিদকে চারজন লোক আমার কাছে হস্তান্তর করে। যদিও তাদের কাউকে চিনি না। তবে দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনে হয়েছে। সেসময় তারা কিছু ইয়াবা ও এক বোতল ফেন্সিডিলও দেন।’
এ বিষয়ে সাভার স্মৃতিসৌধের ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. নূর আলম মিয়া বলেন, ‘ফরিদের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে মাদক আইনে মামলা করা হয়েছে। তবে তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ইয়াবাগুলোর মধ্যে কিছু নকল ইয়াবা রয়েছে। তাই ইয়াবার সঠিক হিসাব পরীক্ষা করার পর নিশ্চিত হতে পারবো।'
বিডি প্রতিদিন/হিমেল