সাভারের আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে কনস্টেবলকে কুপিয়ে হত্যার সময় হামলাকারী ছিল দুইজন। তারা মোটরসাইকেলে করে এসে হামলা চালিয়েই পালিয়ে যায়। এ সময় সেখানে আগে থেকে আরও একজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে।
বুধবার সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাড়ইপাড়া এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে একজনকে হত্যা এবং একজনকে জখম করে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ওই এলাকায় দায়িত্বরত শিল্প পুলিশ-১ এর উপ-পরিচালক কাওসার শিকদারের দাবি, অস্ত্র ছিনতাই করতে না পেরে কনস্টেবল মুকুল হোসেনকে ছুরিকাঘাত করে হামলাকারীরা।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, তল্লাশি চৌকিতে মোটরসাইকেলটি থামানোর পরপরই আরোহীরা ছুরি-চাপাতি নিয়ে পুলিশের উপর হামলা চালায়। আক্রমনের ধরণ দেখে মনে হয়েছে পুলিশকে আক্রমন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
এদিকে আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যার ঘটনায় আইএস জড়িত বলে বুধবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ওয়েবসাইট 'সাইট ইনটেলিজেন্স' বার্তা প্রকাশ করে। তবে এ বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান। বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আইএস'র দায় স্বীকার নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে আইএস'র অস্তিত্ব নেই। ভুয়া নাম ব্যবহার করে আইএস বলা হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে মূলত দেশের মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করতে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। তিনি বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হত্যাকারীদের সনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।
এর আগে সেপ্টেম্বরের শেষ এবং অক্টোবরের শুরুতে ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশিকে হত্যার পর সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়, বিভিন্ন স্থানে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। এর মধ্যেই ২২ অক্টোবর রাজধানীর অন্যতম প্রবেশমুখ গাবতলীতে তল্লাশি চৌকিতে ছুরিকাঘাতে ইব্রাহিম মোল্লা নামে এক এএসআইকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গাবতলীতে এএসআই ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাতকারী হেঁটে আসছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে দুই বিদেশি তাভেল্লা সিজার এবং কুনিও হোসিকে আক্রমণের সময় হামলাকারীরা তিনজন ছিলেন এবং মোটর সাইকেলে করে আসেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে। দুই বিদেশিকে হত্যার সময় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হলেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডে দুটি ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়েছে ছোরার মতো ধারালো অস্ত্র। তবে আশুলিয়ায় হামলাকারীরা পালানোর সময় তাদের সঙ্গে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।
হামলাস্থলে আলামত সংগ্রহে সিআইডি হামলার কয়েক ঘণ্টা পর বাড়ইপাড়ার পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে গিয়ে দেখে ছোপ ছোপ রক্ত। বিনোদনকেন্দ্র নন্দন পার্কের প্রধান ফটকের সামনের এই স্থানটি দিনের বেলায় সরগরম থাকলেও সকালে সেরকম অবস্থা থাকে না, রাতে এলাকাটি থাকে সুনসান। সেখানে ছিনতাই ঠেকাতে কয়েক মাস ধরে আশুলিয়া থানা পুলিশ রাতে-দিনে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে সন্দেহজনক যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছিল। এর আশপাশের আধা কিলোমিটারের মধ্যে জনবসতি বেশ কম। ঘটনাস্থল থেকে অন্তত ২০০ গজ পূর্ব পাশে কয়েকটি ঘর রয়েছে গজারী বনের ভেতরে। সেখানে বিভিন্ন শ্রমিকরা থাকেন। তল্লাশি চৌকিতে কর্তব্যরত বাকি তিন পুলিশ কনস্টেবলও আহত হন বলে পুলিশ জানিয়েছে। স্থানীয় অনেকের মতে, ওই স্থানে পুলিশ চৌকি সম্ভবত কোন অপরাধ চক্র পছন্দ করছে না। এ কারণে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, তল্লাশির নামে হয়রানির কারণেও কেউ ক্ষোভ থেকে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে।
ভারপ্রাপ্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটি মোটরসাইকেলে করে এসে দু'জন দুর্বৃত্ত অতর্কিত হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শী আরিফুর রহমানসহ একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, একটি মোটরসাইকেলে চড়ে কালিয়াকৈরের দিক থেকে আসা দুই যুবক হামলা চালিয়েছিল। কনক দাশ জানায়, চেকপোস্টের কাছে মোটরসাইকেলটি এসে থামে, এরপর পুলিশ কাছে যাওয়া মাত্র ওই দুই যুবক কনস্টেবল মুকুল ও নুর আলমকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। আহত অবস্থায় ওই দুই পুলিশ সদস্য দৌঁড়ে মহাসড়কের পাশের শুভেচ্ছা হোটেল এন্ড রেষ্টরেন্ট ঢুকে পড়ে। সেখানে গিয়েও তাদের কোপায় দুই যুবক। এরপর তারা গজারি বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে। তখন ভয়ে আমি সেখান থেকে চলে আসি।
নাসির হোসেন জানান, মোটরসাইকেলে থাকা দুইজনের বয়স ৩০-৩২ বছর হবে। তারা দু'জন হেলমেট পরা অবস্থায় ছিল। আর পাশে একজনের কাছে একটি ব্যাগ ছিল, তার ভেতর থেকে ধারালো অস্ত্র দুটি বের করে তারা। সে সম্ভবত আগে থেকেই ওই এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। তিনি বলেন, গজারী বন থেকে বেরিয়ে ফাঁকা গুলি করে একটি মেরুন এবং কালো রংয়ের মোটর সাইকেলে চড়ে হামলাকারীরা নবীনগরের দিকে চলে যায়।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহাসিনুল কাদির জানান, মহাসড়কের পাশে যে সব পোশাক কারখানা রয়েছে সেই সব কারখানার সিসি ক্যামেরা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহে নেমেছে পুলিশ। তাদের ধারণা, তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যেই ঘটনা ঘটে গেছে। একটি মোটর সাইকেলে হামলাকারীরা এলেও অন্য মোটরসাইকেলটি সেখানে ওঁৎ পেতে ছিল।
দুইজন হামলাকারীর আক্রমনে তল্লাশি চৌকিতে থাকা পাঁচজন সশস্ত্র কনস্টেবল হকচকিত হয়ে যান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও বলেছেন, কনস্টেবল মুকুল ও নুর আক্রান্ত হলে তার অন্য তিন সহকর্মী পালিয়ে যান গজারি বনের দিকে। তখন একজন ড্রেনে পড়ে আহতও হন। স্থানীয়রাই একটি রিকশা ভ্যানে করে কনস্টেবল মুকুল ও নুরকে কাছের ফাতেমা ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখান থেকে আশুলিয়া থানা পুলিশ ও শিল্প পুলিশ অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মুকুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, সহকর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে দুই কনস্টেবলকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মুকুলকে বাঁচানো যেত। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, নুর আলমের পেটে, মুখে ও বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার অবস্থা আগের থেকে এখন ভালো। চৌকিতে কর্তব্যরত অন্য তিন পুলিশ কনস্টেবল হলেন পিনহারুল ইসলাম, ইমরান আজিজ ও আপেল মাহমুদ। এদের মধ্যে পিনহারুল নর্দমায় পড়ে যান। গজারি বনের দিকে দৌঁড়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের একজন চাপাতি উঁচু করে তাদের (পুলিশ) ধাওয়া দেয় বলে জানান এক প্রত্যক্ষদর্শী।
এদিকে পুলিশ হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাত কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে সকালে আশুলিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন থানার এসআই আজাহারুল ইসলাম। মামলা নং ৮। এ ঘটনায় আশুলিয়ার বিভিন্ন যায়গায় অভিযান চালিয়ে সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। গঠন করা হয়েছে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুর রহমাকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। এ ঘটনার পর আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল নিরাপত্তার চাঁদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পুরো আশুলিয়া জুড়ে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। ঘটনার পর সাভারে অন্তত ১৫টি স্পটে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। সন্দেহজনক সব মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহনে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এ ঘটনায় অপরাধীদের ধরতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনার পরে বাড়ইপাড়ার নন্দন পার্কের সামনে থম থমে অবস্থা বিরাজ করছে। বন্ধ রয়েছে ঘটনাস্থলের পাশের সব দোকান পাট। অন্যদিকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে আশুলিয়া থানার এসআই হাবিবকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/০৫ নভেম্বর ২০১৫/এস আহমেদ