চট্টগ্রাম মহানগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম পাঁচ সড়ক এখন মড়কে পরিণত হয়েছে। এসব সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল প্রায় অনুপযোগী। চরম ঝুঁকি নিয়ে যান চললেও গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট ও দুর্ঘটনা সঙ্গী হয় প্রতিনিয়ত। ফলে অনাকাঙ্খিতভাবে ব্যয় হয় যাত্রীর সময়। ক্ষতির সম্মুখিন হয় যানবাহনের মালিক। বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, উন্নয়ন সংস্থার খোঁড়াখুড়ি এবং মানহীন জোড়াতালির সংস্কারের সড়কের এমন বেহাল অবস্থা।
নগরের ব্যস্ততম এই পাঁচ সড়ক হলো- নগরের মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন, দুই নং গেইট থেকে অক্সিজেন, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, বহদ্দার হাট থেকে কালুরঘাট রোড, বহদ্দার হাট থেকে কর্ণফুলী সেতু সংযোগ সড়ক।
জানা যায়, গত কয়েকদিন বৃষ্টি কমার পর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত কাজ শুরু করেছে চসিক। প্যাচ ওয়ার্ক করে অধিকাংশ গর্ত ভরাট করা হয়েছে। স্ট্র্যান্ড রোড, মেরিনার্স রোড, অলঙ্কার মোড, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, ডিটি রোড, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেইট এলাকাসহ ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে সংস্কার কাজ চলছে।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৃষ্টি কমার পর থেকে সড়ক সংস্কার কাজ জোরদার করা হয়েছে। ৯টি দলে ভাগ হয়ে প্রতি দলে ১৫-২০ জন করে কাজ করছেন। তাছাড়া স্টোরে ও প্ল্যান্টে ১৫-২০ জন লোক। বেশি খারাপ হয়েছে এমন সড়কগুলো জরুরি ভিত্তিতে রোলিং দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে। আপাতত বিটুমিন দিয়ে কাজ করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এক্সেস রোড, মুরাদপুর-অক্সিজেন রোড, আরাকান রোড, মেরিনার্স রোড, দুই নং গেই-অক্সিজেন রোডে বিটুমিনাস ওয়ার্ক চলছে।
বহদ্দারহাট-কালুরঘাট সড়ক
বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট। মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের এই সড়কের তিন কিলোমিটারেরও বেশি সড়কের অবস্থা চরম নাজুক। গণপরিবহনে করে ৩০ মিনিটের এই সড়ক অতিক্রম করতে লাগে এক ঘণ্টার চেয়েও বেশি। অতিবর্ষণে সড়কের যেমন বেহাল দশা, তেমনি যোগ হয়েছে ফ্লাইওভার র্যাম্পের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি। আছে ওয়াসার খোঁড়াখুড়ি। ফলে অন্তহীন দুর্ভোগ সঙ্গী হয়েছে এই পথের যাত্রীদের। সড়ক রুপ নিয়েছে মড়কে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতি বর্ষণে উঠে যায় সড়কের পিচ। সৃষ্টি হয়েছে বড় গর্ত। তাতে জমে আছে পানি। চরম ঝুঁকি নিয়েই চলতে হচ্ছে এ সড়ক দিয়ে। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। উল্টে যায় পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান। বিকল হচ্ছে তিন চাকার যান। মুমূর্ষু রোগীদের চলতে হয় প্রাণ হাতে নিয়ে।
এই সড়কের বহদ্দারহাট, বাস টার্মিনাল, পুরাতন চান্দগাঁও থানা, সিএন্ডবি রাস্তার মাথা, মৌলভী পুকুর পাড়, ওসমানিয়া গ্লাস শিট, কামাল বাজার, মোহরা রাস্তার মাথাসহ সব এলাকার সড়ক প্রায় নষ্ট।
চাঁন্দগাও এলাকার বাসিন্দা আহমেদ রেজা বলেন, ‘প্রতিদিন মোহরায় নিজের কর্মস্থলে যেতে যে বেগ পেতে হয়, তা বলার মত না। বাণিজ্যিক রাজধানীতেও এমন সড়ক থাকে তা ভাবতেই অবাক লাগে। অথচ এই সড়ক দিয়েই কালুরঘাট শিল্পাঞ্চলে যেতে হয় যানবাহন ও বিনোয়গকারীদের।’
মুরাদপুর-অক্সিজেন
মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন মোড়। দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার। উত্তর চট্টগ্রাম এবং রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ির মানুষদের যাতায়াতের প্রধান সড়ক। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত এখন মরণযন্ত্রণায় রূপ নিয়েছে। গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে এসড়ক দিয়ে যাতায়াত চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। উঠে যায় পিচ। সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ওয়াসার খোঁড়াখুড়ি।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুরাদপুরের পরই রেল লাইন, বিবিরহাট, হামজারবাগ পর্যন্ত সড়কে বড় বড় গর্ত। রিক্সা, অটোরিক্সা ও অটোটেম্পো এ সড়ক দিয়ে চলা দায়। স্থানীয় দোকানদার শাহজাহান বলেন, ‘গত ৮ মাসে রাস্তার গর্তে পড়ে গাড়ি উল্টে অনেকেই আহত হয়েছেন।’ এরপর রৌফাবাদ থেকে শুরু হয় আরেক নরক যন্ত্রণার সড়ক। টেম্পো চালক কফিল উদ্দিন বলেন, বড় বড় গর্তে ভরপুর এ সড়ক। গর্তে পড়ে প্রতিনিয়তই গাড়ি উল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। গত ৬ মাসে অনেক গাড়ির চাকা নষ্ট ও ফেটে যায়। অথচ একটি চাকার দাম প্রায় ৬ হাজার টাকা।’ অভিন্ন অবস্থা আতুরার ডিপো থেকে অক্সিজেন মোড় পর্যন্ত সড়কেও।
বহদ্দারহাট-নতুন ব্রিজ
বহদ্দার হাট থেকে নতুন ব্রিজ সড়কটি চট্টগ্রাম কক্সবাজা মহাসড়কের অংশ। নগর থেকে এ সড়ক দিয়েই দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাত উপজেলা এবং বান্দরবান ও কক্সবাজারের মানুষ যাতায়াতের একমাত্র সড়ক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এ সড়কে মেরামতের কোনো বালাই নেই। এ সড়কের এক কিলোমিটার থেকে রাহাত্তারপুল হয়ে কালামিয়া বাজার পর্যন্ত বিছানো হয়েছে ইট।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের বিভিন্ন অংশে উঠে তৈরি হয়েছে ছোট বড় গর্ত। গর্তে জমে পানি। এক কিলোমিটার, রাহাত্তারপুল, বাকলিয়া থানা, কালামিয়া বাজার, রাজাখালি ও শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক পর্যন্ত গর্তকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালানো দায় বলে মনে করেন চালকরা। সড়ক ও জনপথ দোহাজারি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সড়কটি নিয়ে দুটি প্রকল্প চলমান। তবে দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পগুলো চলছে ধীরগতিতে। ফলে সড়কের অবস্থা খারাপ। তাছাড়া সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টির কারণেও রাস্তা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সাময়িক ভাবে ইটের টুকরো দিয়ে সংস্কার করা হচ্ছে। বৃষ্টি কমলে বিটুমিন দিয়ে চূড়ান্ত মেরামত করা হবে।
পোর্ট কানেকটিং রোড
নগরের পোর্ট কানেক্টিং রোড। এ ট্রাক দিয়েই যাতায়াত করে বন্দরগামী লরি, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ ভারী যানবাহনগুলো। এ সড়কের ভাল-মন্দের সঙ্গে জড়িত বন্দরের পণ্য উঠা-নামা। ফলে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধির সঙ্গেও যুক্ত এ সড়কটি। এমন গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিরও বেহাল দশা। এ রোডের পুরো অংশেরই অবস্থা করুণ। সড়কে এতবেশি গর্ত, যে যানবাহন একটি পাশ কাটাতে গেলে আরেকটিতে পড়তে হচ্ছে। সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিয়েই এ সড়ক দিয়ে যানবাহন যাতায়াত করছে। এ সড়কের অলংকার, সরাইপাড়া, নয়াবাজার বিশ্বরোড, হালিশহর, বড়পুল, আগ্রাবাদ, গোসাইলডাঙ্গা এলাকার অংশ বেহাল অবস্থায় আছে।
প্রাইম মুভারস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘বন্দর থেকে যানবাহন যাতায়াতের প্রধানতম সড়ক এটি। এই সড়কের সঙ্গে বন্দরের অনেক কিছুরই নির্ভরশীল। অথচ এটিরই অবস্থা বেহাল। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে গাড়ি চালাতে গেলে এক্সেলস ভেঙে যায়।’
দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোরশেদ আক্তার চৌধুরী বলেন, ‘টানা বর্ষণে সড়কের অধিকাংশই খারাপ। তাই সাময়িক ভাবে ইট দিয়ে গর্ত ভরাটের কাজ চলছে। বৃষ্টি কমে গেলে বড় প্রকল্পের মাধ্যমে সংস্কার কাজ করা হবে।’
দুই নং গেইট-অক্সিজেন
নগরের দুই নং গেইট-অক্সিজেন সড়ক। দুই নং গেইট থেকেই ক্ষতবিক্ষত সড়ক শুরু। এ মোড় থেকে শুরু হয় ফ্লাইওভারের লুপ তৈরির কাজ। ফলে নির্মাণ কাজের দুই পাশের অবস্থা চরম নাজুক। এরপর রেল লাইন, কর্ণফুলী বাজার, রুবি গেইট, পলিটেকনিক মোড়, টেক্সাটাইল মোড় ও বায়েজিদ পর্যন্ত সড়কের অবস্থা অত্যন্ত বেহাল।
বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন