রাজধানী ঢাকা শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। গবেষণা তারা দেখতে পেয়েছে যে, রাজধানীর জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫১ শতাংশই ‘নতুন দরিদ্র। সংস্থাটি বলেছে, ‘করোনার অভিঘাতে নতুন এক সামাজিক শ্রেণি হিসেবে উত্থান ঘটেছে নতুন দরিদ্রের।’
যদিও কভিডকালে শহরাঞ্চলের সামগ্রিক দারিদ্র্য কমেছে। ২০১৯-২০২২ সালের মধ্যে দারিদ্র্য কমেছে ৪ দশমিক ৯ শতাংশীয় পয়েন্ট।
গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে শুরু হয় দুদিনব্যাপী ‘বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক ২০২৩’ শীর্ষক সম্মেলন। উদ্বোধনী অধিবেশনে শহরাঞ্চলের নতুন দরিদ্র নিয়ে গবেষণার তথ্য প্রকাশ করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। গেস্ট অব অনার ছিলেন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিৎ কর্মকার।
‘আরবান পভার্টি ডায়নামিক ডিউরিং দ্য টাইম অব করোনা : এভিডেন্স ফ্রম আ প্যানেল স্টাডি অন দ্য ঢাকা সিটি’ শীর্ষক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দারিদ্র্য কমার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি। করোনার শুরুর দিকে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ ছিল। তবে ২০২২ সালের শুরুতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এতে ঢাকা শহরে কমে দারিদ্র্যের হার। ২০১৯ ও ২০২২ সালের মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে চরম দরিদ্র পরিবারের অনুপাত কমেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট।
বিআইডিএস ২ হাজার ৪৬টি খানার ওপর জরিপ করে গবেষণাটি করেছে। এতে দেখা যায়, করোনার আগে ২০১৯ সালে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। করোনার পর ২০২২ সালে তা বেড়ে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে করোনার আগে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। করোনার পর বেড়ে ৩৩ দশমিক ২১ শতাংশে দাঁড়ায়।
এছাড়া ২০১৯ সালে দরিদ্র খানা বা পরিবারের মধ্যে ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস) ব্যবহার করত। করোনার পর অর্থাৎ ২০২২ সালে তা বেড়ে ৭৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ হয়েছে। করোনার আগে ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবারের ব্যাংক হিসাব ছিল। পরে তা বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘করোনার সময় দারিদ্র্য বাড়লেও এটা ছিল সাময়িক, যা পরবর্তীকালে কমতে শুরু করে। একপর্যায়ে স্বাভাবিকের জায়গায় চলে আসে। তবে শহরাঞ্চলের সামগ্রিক দারিদ্র্য কমেছে। এ দারিদ্র্য কমার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আত্মকর্মসংস্থানের প্রচেষ্টা। আধুনিক প্রযুক্তি বিশেষ করে মোবাইলে আর্থিক সেবার ব্যবহার দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে সহায়তা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজধানীর মোট দরিদ্রের প্রায় ৫১ শতাংশ নতুন দরিদ্র, যারা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে নেমে গেছে। সংকটে থাকা এ নতুন শ্রেণির ওপর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। গ্রাম ও শহরের ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছে। কারণ গ্রামের মানুষ এখন শহরের মতো অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। সংবিধানেও এ দুইয়ের বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।’
শহরে আয় বাড়ার সঙ্গে বৈষম্য বাড়ার প্রসঙ্গ টেনে বিনায়ক সেন বলেন, ‘নগরের দারিদ্র্য ৪০ শতাংশের বেশি হলে মেগা সিটিগুলো প্রবৃদ্ধির সুবিধা পায় না। এক্ষেত্রে বাড়তি বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।’
গবেষণা অনুযায়ী, শহরে অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে এমএফএস ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। ২০১৯ সালে এসব পরিবারের মধ্যে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ এমএফএস ব্যবহার করত। করোনার পর তা বেড়ে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়েছে। তবে অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ব্যাংক হিসাব খোলার প্রবণতা বাড়েনি।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘সম্পদ যখন সৃষ্টি হয় তখন বৈষম্য অবধারিত। কারণ কেউ মেধার গুণে বা যোগ্যতার ভিত্তিতে বেশি সম্পদ সৃষ্টি করে। বৈষম্য প্রশমনে আমরা কাজ করছি। তারই অংশ হিসেবে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার মতো ভাতা দেয়া হচ্ছে। তারা কাজ না করেও ভাতা পাচ্ছেন। সমতাভিত্তিক সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে বৈষম্য কমানো সম্ভব। আমরা সেটিই করার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘আগে মানুষ এত দরিদ্র ছিল যে তখন বৈষম্য নিয়ে চিন্তা ছিল না। এখন সবাই খেতে পারে। এ কারণে বৈষম্য নিয়ে কথা আসছে। আমরা সম্পদ সৃষ্টি করতে চাই। ভাত, মাছ, মাংস, ডিমের মতো সম্পদ গড়তে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।’
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ