একাত্তরের মার্চ মাসের রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। কারণ এখানে বিগত ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের যোগফল রূপান্তরিত হয় মুক্তিযুদ্ধ রূপে। আর তার মূলে একাত্তরের পহেলা মার্চ পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের একটি ঘোষণা। যা দ্বারা ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবি করা হয়। এই ঘোষণাটি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, গণ অভ্যুত্থানে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান '৬৯ সালের ২৫ মার্চ সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন। ইয়াহিয়া সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য ইয়াহিয়া খান এখানে জানোয়ার হিসেবে অভিহিত। আমার মতে পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কারণে তার জন্য এ অভিধাটি জুটেছে। নতুবা সেনা শাসকদের মধ্যে ইয়াহিয়া খান হতেন শীর্ষ স্থানীয় উদার সেনাশাসক। কারণ তিনিই একমাত্র সেনা শাসক যিনি নিজে রাজনৈতিক দল করে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার চেষ্টা করেননি। বলা প্রয়োজন হাজার মাইল দূরত্বে অবিস্থত দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল উদ্ভট রাষ্ট্র পাকিস্তান। এখানে জনসংখ্যার হিসেবে পূর্ববাংলা প্রদেশে ছিল শতকরা ৫৬% শতাংশ এবং পশ্চিম অংশে পাঁচটি প্রদেশ মিলিতভাবে ছিল শতকরা ৪৪% শতাংশ। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম বাজেটে উন্নয়ন খাতে ২৮ হাজার টাকার বরাদ্দ ছিল। প্রতিটি প্রদেশের জন্য ৫০০০ টাকা এবং রাজধানী করাচির জন্য ৩০০০ টাকা। ফলে ৪৪% লোকসংখ্যার অঞ্চল পশ্চিম অংশ পেল ২৩০০০ টাকা আর ৫৬% লোকসংখ্যার অঞ্চল পেল মাত্র ৫০০০ টাকা। আর এটাই হলো বঞ্চনার প্রথম নমুনা। অপরদিকে জাতীয় পরিষদে জনপ্রতিনিধিত্বে ছিল পাঁচটি প্রদেশের হারে, জনসংখ্যা হারে নয়। ফলে গণতন্ত্র ছিল অস্বীকৃত। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রাদেশিক প্রথা বাতিল করে দুই ইউনিট প্রথা চালু করেন। ফলে পাকিস্তান পরিণত হয় একটি দুই ইউনিট রাষ্ট্রে। এখানে জাতীয় পরিষদে আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় সমতার ভিত্তিতে। ফলে ৩০০ আসন বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে পূর্বাঞ্চল ১৫০ জন এবং পশ্চিমাঞ্চল ১৫০ জন জনপ্রতিনিধি প্রাপ্ত হয়। এখানেও গণতন্ত্রের স্বীকৃতি নেই। সেনাপতি ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা লাভ করে প্রথমেই এক ব্যক্তি এক ভোট প্রথা চালু করে পাকিস্তান প্রথম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। আর এই ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয় লাভ করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের জন্য পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তার জন্য প্রয়োজন ছিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। আর এই অধিবেশনটি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ডাকা হয়েছিল। স্বাভাবিক কারণেই এই অধিবেশনটি বাঙালিদের একটা বিরাট প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিল। পহেলা মার্চের অধিবেশনটি মুলতবি ঘোষণাটি ছিল বাঙালিদের প্রত্যাশার জন্য বজ ঘাত তুল্য। তাই ঘোষণাটির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিণত হয় আগ্নেয়গিরিতে। ফলে শুধু ঢাকা নয় দেশময় সৃষ্টি হয় প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের মিছিলের জোয়ার। তবে সবার দৃষ্টি ছিল বঙ্গবন্ধুর দিকে। এখানে বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক কৌশলী পদক্ষেপগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু এখানে শুধু আওয়ামী লীগ প্রধান নন, তিনি এখন জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলনেতা তথা পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। তাই তাকে আবেগের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিলে চলবে না। ফলে কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম কমিটি করার নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য তার পক্ষে এখানে যা করার সম্ভব নয় সেইগুলো করবে এই কমিটি। অপরদিকে ঘোষণা দেন অসহযোগ আন্দোলনের। এই ঘোষণার ফলে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা পরোক্ষভাবে তার হাতের মুঠোতে এসে যায়। ফলে বিদায় নেয় পাকিস্তানি শাসন। অপরদিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ফলে পাকিস্তান পরিণত হয় ভিন্ন দেশে। অতঃপর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথায় আসা যাক। ৬ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু ভবনের ছাদে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বৈঠক বসেছিল। আমি সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। এখানে সদস্যগণ ৭ মার্চের ভাষণের রূপরেখা তৈরিতে যে যার মতো প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু শুধুই শুনে যান। পরদিন ৭ মার্চ সকাল বেলায় আমি ধানমন্ডির ৩০নং রোডে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২নং আসামি আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করি। এমন সময় হঠাৎ লুঙ্গি পরা বঙ্গবন্ধুকে রুমে ঢুকতে দেখে অাঁতকে উঠি। বঙ্গবন্ধু রুমে ঢুকেই রহমান সাহেবকে নিয়ে বিশাল ড্রইং রুমের এক কোণে গিয়ে বসেন এবং তার হাতের কাগজের বান্ডিলটি খুলে প্রতিটি কাগজ পর্যালোচনা করেন। এখানে বুঝতে পারলাম যে, ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ব্যক্তি থেকে লিখিত মতামত এনেছেন। অতঃপর নিজের মতো করে তৈরি করেছিলেন ভাষণটি, যাতে ছিল স্বাধীনতা লাভের দিক নিদের্শনা। আর এই নির্দেশনায়ই অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৭ মার্চ রেসকোর্সে সেদিন আমিসহ দলের ওয়ার্কিং কমিটির ৪৯ সদস্য মঞ্চে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু গণ পরিষদ সদস্য কুমিল্লার লাকসামের বাসিন্দা জালাল আহমেদকে কোরআন তেলোয়াত করতে বলেন । এখানে একটা বিষয় লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। যা কোনো দিনই আলোচিত হয়নি এবং তার সম্ভাবনাও নেই। তাই তা লিখছি। তা হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল যদি বাস্তবায়িত হতো তা হলে আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু হতেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো হতেন বিরোধী দলীয় নেতা। ফলে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে চালু হতো ধর্মনিরপেক্ষ শাসন। কিন্তু পাকিস্তানি শামকচক্র তা হতে দেয়নি। আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৫ আগস্ট আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। সঠিক নেতৃত্ব পেলে সম্ভাবনাময় না থেকে এত দিনে বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হতো। অনুলিখন : মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা