ফেসবুকে চলছে নেতাদের বাহাস (তর্ক-বিতর্ক)। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য’ নামে প্ল্যাটফর্মে রাজধানীর শাহবাগে সমবেত হয় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। আন্দোলন সফল হওয়ার পর এ সংগঠনগুলোর নেতাদের বক্তব্যে সরগরম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন চলাকালীন ছাত্রশিবিরের দেওয়া ‘গোলাম আযমের বাংলায়, ফ্যাসিবাদের ঠাঁই নাই’ শীর্ষক স্লোগান এবং জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা এবং জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত সমন্বয়ক মাহফুজ আলমের একটি স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়ে। গত রবিবার ‘দুটি কথা’ শীর্ষক এই পোস্টে তিনি বলেন, ’৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চলিয়েছে। (পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইলেও, তদুপরি আবারও ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে-বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোট্যাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।’ মাহফুজের এ পোস্টের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় জামায়াত ও শিবির অনুসারীরা। এর সঙ্গে যোগ দেন এনসিপির নেতারাও। মাহফুজের সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ উপলক্ষে আনন্দভোজনের উদ্দেশে মাহফুজের নামকৃত গরু জবাই দিতে দেখা যায় কয়েক শিক্ষার্থীকে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘হাসিনা না হয় গড়পড়তা রাজাকার বলায় আমরা স্যাটায়ার করেছি, কিন্তু যে সত্যিকারের রাজাকার তাকে কি রাজাকার বলা যাবে না? গোলাম আজম কি রাজাকার না?’ অপর এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়! লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাপের না! গোলাম আজম তুই রাজাকার, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার?’ প্রতিক্রিয়া জানান এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘এই বাংলার স্বকীয়তা বিনষ্ট করার কোনো প্রকল্প মেনে নেওয়া হবে না। এ দেশে বহু জাতিগোষ্ঠীর নানান সংস্কৃতি, ততধিক ভাষা ও সব ধর্মের পারস্পরিক আন্তরিক সহাবস্থানকে পিছিয়ে দিতে ইতিহাসের বাঁকে কিছু সাবোট্যাজিং পক্ষ ছিল, এখনো তাদের রাজনৈতিক সিলসিলা চলমান।.. এহেন তৎপরতা রাজনৈতিক আর সামাজিকভাবে মেনে নেওয়া হবে না। একাত্তরের সংগ্রামকে অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও মধ্যবিত্ত-নিম্নবর্গের মানুষের সক্রিয় পলিটিক্যাল এজেন্সিকে বাদ দেওয়া। আজ যারা নিজেদের গণ অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করে তারা নারীদের রাজনৈতিক মহলে আতঙ্কিত ও সংকুচিত করার চেষ্টায় লিপ্ত। এ ঘৃণ্য চেষ্টা বৃথা।... পুরোনো রাজনীতির প্রথার ধারক ও বাহকরা দ্রুতই ছিটকে পড়বে এবং বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব ও ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখবে।’ ঘটনা পরম্পরায় এক বিবৃতিতে দলীয় অবস্থান জানায় এনসিপি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এনসিপি’র কোনো সদস্য সাম্প্রতিক আন্দোলনে দলীয় স্লোগান কিংবা এই জনপদের মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাসবিরোধী কোনো স্লোগান দেয়নি। ফলে যেসব আপত্তিকর স্লোগান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পক্ষটিকেই বহন করতে হবে। এনসিপিকে এর সঙ্গে জড়ানো সম্পূর্ণ অহেতুক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।’ দলটি আরও বলে, ‘যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করে জাতীয় সমঝোতা ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নে সহযোগী হবে।’ এদিকে পৃথক দুই পোস্টে গতকাল এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘দয়া করে আওয়ামী বাইনারিগুলো প্রচার করে বিভেদে জড়াবেন না। ঐক্যের সময়ে বিভেদ চাই না। ফ্যাসিস্টবিরোধী ঐক্য যে কোনো মূল্যে আমাদের আরও দৃঢ় করতে হবে। সামনে বহু লড়াই বাকি। এমন বিভাজন আর বিভক্তি কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে যে বিভক্তি কিংবা বিভাজনকে আপনারা উসকে দিচ্ছেন, এর পরিণতি পুরো জাতিকেই ভোগাবে। শুধুই বলব আপনারা ফাঁদে পড়েছেন, অথবা অজান্তে নিজেরাই নিজেদের জন্য ফাঁদ তৈরি করছেন।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এসব বাহাসের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল এক স্যাটায়ার পোস্টে লিখেছেন, ‘মেরেছ কলসির কানা! তাই বলে কি প্রেম দিব না? প্রেমের সম্পর্কে টুকটাক মন কষাকষি হতেই পারে। তবে বেশি জনসম্মুখে না হওয়াই ভালো। মেনে নিন, টক্সিসিটিই প্রেমের সৌন্দর্য।’