একটা সময় ছিল, টেলিভিশনের পর্দা খুললেই দেখা যেত তাঁদের মুখ। গম্ভীর সংলাপ, প্রাঞ্জল অভিব্যক্তি আর অসম্ভব সহজ অভিনয়শৈলীতে তাঁরা আমাদের হৃদয়ে গেঁথে গেছেন চিরদিনের মতো। বাংলাদেশের নাট্যদুনিয়ায় তাঁদের পদচারণ শুধু সময়ের নয়, প্রজন্মের সাক্ষ্য বহন করে। এরা শুধু শিল্পের পরিচায়ক নন, আমাদের সংস্কৃতির আত্মার প্রতিচ্ছবি। এঁদের মধ্যে কেউ অভিনয় করছেন পাঁচ দশক ধরে, কেউ ছয় দশক ধরে। বয়স তাঁদের অভিনয় থেকে দূরে সরাতে পারেনি। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন অভিনয় করে। তাঁদের অনেকেই এখনো অভিনয়ে সরব আছেন। কেউ কেউ অবশ্য প্রতি মাসেই শুটিং করছেন আবার কেউ কালেভদ্রে নাটকে কাজ করছেন। সেই সিনিয়র অভিনয়শিল্পীরা কেমন আছেন? কেমন কাটছে তাঁদের দিনগুলো?
বাংলাদেশের নাট্য ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় গুণী অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও নির্মাতা আবুল হায়াত। অভিনয়ই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। জীবনের ৮১টি বসন্ত পার করেছেন। বয়সের ভার তো বটেই, সেই সঙ্গে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনের জয়গান গাইছেন সর্বদা। বয়স ও অসুখকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সমানতালে নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয়, লেখালেখি ও নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। নিজের আত্মজীবনী ‘রবি পথ’ প্রকাশ করেছেন। সহধর্মিণীকে নিয়ে দেশ-বিদেশ চষে বেড়াচ্ছেন নিজের ইচ্ছামতো। ঘুরছেন, ছবি তুলছেন। মেয়ে বিপাশা-নাতাশা, জামাই তৌকীর আহমেদ কিংবা শাহেদ শরীফ ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে জীবন উদযাপন করছেন। নাটকের পরিবারদের আয়োজনে সশরীরে অংশ নিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফটোশুটে অংশ নিচ্ছেন। ফেসবুকেও তিনি খুবই সক্রিয়। এই তো রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তৌকীর আহমেদ ও ফারজানা ছবিকে নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘সম্পত্তি সমর্পণ’। তাই বলা যায়, এই তারকার চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতা আজও থেমে নেই।
অন্যদিকে, লেখালেখি ও নাট্যচর্চা থেকে একদমই সরে যাননি এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। একই ধারায় দিলারা জামানও রয়েছেন নাটক-সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের ব্যস্ততা নিয়ে। বয়স তাঁর কাছে একটি সংখ্যা মাত্র। বয়স বাড়লেও মনের জোরে আজও তিনি নতুন কিছু শেখার ও শেখানোর মধ্যে রয়েছেন। একটার পর একটা সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে বা মায়ের চরিত্রে কাজ করছেন সিনিয়র অভিনয়শিল্পী হিসেবে। গুণী এই অভিনেত্রী মাঝেমধ্যেই নতুন নতুন লুক এবং মেকআপে চমকে দেন। এই গুণী অভিনেত্রী দেশে একা থাকেন, আর তাঁদের সন্তানরা থাকেন প্রবাসে। দিলারা জামানের দুই মেয়ে। দুজনই থাকেন দেশের বাইরে। পড়ালেখার জন্য দূরদেশে পাড়ি দেওয়া দুই সন্তান পরবর্তী সময়ে সেখানেই গড়েছেন ক্যারিয়ার। মা দিলারাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের কাছে। তবে শিকড়ের টানে তিনি ফিরে এসেছেন। সন্তানরা নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। সুযোগ পেলে প্রতি বছর দেশে আসেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আর পর্দার সন্তানদের মায়ায় রয়ে গেছেন তিনি দেশে। আরেক গুণী অভিনেত্রী ও পর্দার মা ডলি জহুর। যিনি জীবনের সুন্দর সময় উৎসর্গ করেছেন মঞ্চ ও টিভি নাটক ও সিনেমায়। তিনিও দেশে থাকেন একা। তাঁর একমাত্র সন্তান রিয়াসাত স্থায়ী হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। মাঝে মাঝে ডলি জহুর যেমন ছুটে যান ছেলের কাছে, আবার ছেলেও সময় পেলে আসেন মায়ের কাছে। তবে এ দেশ ও মানুষের ভালোবাসার কারণে বিদেশে স্থায়ী হতে পারেননি। বিশেষ করে পর্দার সন্তানদের মায়া তাঁকে আটকে রেখেছে। অভিনয়ে কম সক্রিয় হলেও বিশেষ নাটক বা সিনেমাতে এখনো তাঁকে দেখা যায়। সময় দেন পরিবারে, ধর্মীয় অনুশাসনে, আর মাঝে মাঝে স্মৃতিচারণায়। এদিকে প্রখ্যাত অভিনেত্রী আফরোজা বানু এখন কানাডার অটোয়ায় মেয়ে কৃষ্টি রেজা, নাতনি ও পরিবারের সঙ্গে সুন্দর সময় পার করছেন। তবে থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর বন্ধন এখনো অটুট রয়েছে। টরন্টোর মেইনস্ট্রিম থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ‘ট্রাইডেন্ট মুন’ নামের নাটকের প্রদর্শনীতে নিয়মিত অভিনয় করছেন। অভিনয়ের বাইরে ঘরোয়া জীবন এবং সাহিত্য চর্চায় দিন কেটে যায় তাঁর।
বিশিষ্ট অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী, এখনো অভিনয় থেকে থেমে যাননি। ‘হাড়কিপ্টে’ খ্যাত এই অভিনেতা এখনো সমান গতিতে নাটকে অভিনয় করে চলেছেন। তবে গ্রাম্য আবহের নাটকেই তিনি বেশি কাজ করছেন। মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপন ও সিনেমায় অভিনয় করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে সাদামাটা, কিন্তু চিন্তায় তীক্ষ্ণ তিনি। এদিকে, আফজাল হোসেন আজও বহু ধারায় সক্রিয়-নাটক, সিনেমা, ওটিটি, বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও অভিনয়, কবিতা ও চিত্রকলা সবখানেই তাঁর প্রতিভার ছাপ। ঈদে মৌয়ের সঙ্গে জুটি হয়ে করেছেন নাটক ‘কোনো একদিন’। ‘ছোটকাকু’ সিরিজও নিয়মিত করছেন। ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি লেখালেখি-আঁকাআঁকিতেও সক্রিয় বেশ। তাঁর অভিনীত ‘যাপিত জীবন’ সিনেমা রয়েছে মুক্তির অপেক্ষায়। নির্মাণ করেছেন, শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘মানিকের লাল কাঁকড়া’, যেটিও সামনে আসবে। এদিকে নতুন খবর হচ্ছে রায়হান রাফির ‘তাণ্ডব’ সিনেমায় নতুন রূপে সামনে আসছেন তিনি। একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য এ অভিনেতা-নির্মাতাকে পুলিশের স্পেশাল ফোর্স ‘সোয়াত’-এর প্রধানের ভূমিকায় দেখা যাবে। আর সামনে বেশ কিছু ওটিটি কনটেন্টে দেখা যাবে তাঁকে। বরেণ্য অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক তারিক আনাম খান এখনো অনবদ্য। নাটক, চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজে তাঁর অভিনয় মানেই দর্শকদের জন্য বাড়তি প্রত্যাশা। নিয়মিত অভিনয় করছেন সর্ব মাধ্যমে। এই অভিনেতা শুধু অভিনয় শিল্পীই নন, অভিনয়ের এক ইনস্টিটিউশনও। নায়ক না হয়েও বহুমাত্রিক চরিত্রাভিনেতা হিসেবে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘হিরো’ই হয়ে আছেন তিনি। থিয়েটার থেকে শুরু করে ছোট পর্দা, বড় পর্দা, ওটিটি কোথায় তাঁর দাপুটে বিচরণ নেই! ঈদে তাঁর অভিনীত ‘মানুষ কি বলবে’ সবার মাঝে প্রশংসিত হয়। নিয়মিত করছেন ধারাবাহিক ‘একান্নবর্তী’। বেশ কিছু সিনেমাতেও কাজ করছেন। সম্প্রতি বিচারক হিসেবে ছিলেন দীপ্ত ট্যালেন্ট হান্টে। এদিকে খায়রুল আলম সবুজ মঞ্চ এবং টেলিভিশনে এখন নিয়মিত হন। তবে মাসুম বাশার নিয়মিত কাজ করছেন টিভি নাটকে। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর সহধর্মিণী মিলি বাশার। নতুন নাটকের ভিত গঠনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তরুণদের সঙ্গে সময় দেন, অভিনয় করে ও শেখান। এদিকে রাইসুল আসাদ, তাঁর অভিনয়ে ঝলসে ওঠে বাস্তবতা, চরিত্রের গভীরতা। তবে এখন অভিনয়ে নিয়মিত নন। আর ফেরদৌসী মজুমদার মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। বর্তমানে কিছুটা বিশ্রামে থাকলেও তিনি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সভায় নিয়মিত অতিথি।