গত ১৫ বছরে পুলিশের কেনাকাটায় ভয়াবহ নয়ছয়ের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ৩০০ ধরনের পণ্য কেনাকাটায় লুট করা হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এসব অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে অন্তত ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিগত সরকারের আমলে কাজ পাওয়া এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- টেক স্কোয়াড, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, রয়্যাল সুজ, জেরিন টেক্স, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি ট্রেড, ফ্রেন্ডস ট্রেডিং, ওয়ার্ল্ড বিডি, সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল এবং জিএম গ্লোবাল।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনালের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আশরাফ হোসেন। তার প্রতিষ্ঠান গত অর্থবছরে পুলিশের বুটের ২ লাখ পেয়ার সরবরাহের কাজ পায়। তাকে কাজ দিতে তিনবার পুনঃটেন্ডার করা হয়। এখনো ওই প্রতিষ্ঠান মালামাল সরবরাহ করতে পারেনি। জিএম গ্লোবালের মালিক সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদের ভাই গোলাম মোহাম্মদ টিটু, ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবুল কালাম আজাদ। ওয়ার্ল্ড বিডির মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার। তার এই প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করে কম্পিউটার সরঞ্জামাদি এবং বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। কিন্তু কার্যাদেশ পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠান কোনো মালামাল সরবরাহ করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, টু ইনভিলাপ পদ্ধতিতে গুণগত মান ঠিক রেখে সর্বনিম্ন দাম কে ধরছে, আর কে ধরছে না তা জানা যায় না। তাই বিগত দিনে শীর্ষ কর্মকর্তাদের পছন্দ অনুযায়ী তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে এবং ধরে নেওয়া হয়েছে তারা গুণগত মান ঠিক রেখে সর্বনিম্ন দর দিয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (লজিস্টিক) মোসলেহ উদ্দিন আহমদ এ প্রতিবেদককে বলেন, চলতি অর্থবছরের টেন্ডারগুলো আগেই হয়ে গেছে। আগামীতে যে টেন্ডারগুলো করছি বা করব সেগুলোতে অবশ্যই স্বচ্ছতা পুরোপুরি নিশ্চিত করব। পিপিআর, আইন ও বিধির আলোকে যেটা করা দরকার সেটা আমরা করব।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলের দুটি অর্থবছরে পুলিশের কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কেনাকাটার নামে লুট করা হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এসবে সুবিধা করে দেওয়ায় মূল অভিযুক্ত তৎকালীন এক অতিরিক্ত ডিআইজি। তিনি বর্তমানে একটি রেঞ্জে ডিআইজি হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০১৬-২০১৭ ও ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে পুলিশ সদস্যদের পোশাকসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনাকাটায় ওই লুটের ঘটনা ঘটে। সে সময় তদন্তে এই অনিয়মের চিত্র ধরা পড়লেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিগত সরকার। এসবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও তার সিন্ডিকেট সদস্যদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ ছিল।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সাপ্লাই শাখার কেনাকাটায় শুধু পুলিশ বাহিনীর ইউনিফর্ম যেমন- কাপড়, জুতা, মোজা, জুতার কালিসহ বিভিন্ন মালামাল ক্রয় করা হয়। ইক্যুইপমেন্ট শাখা থেকে হেলমেট, পুলিশ বাটন, রায়টসেইল্ড, ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট, মাল্টিপারপাস বেল্টসহ নানা ধরনের মালামাল কেনা হয়।
২০১৬-২০১৭ ও ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনাকাটা করা হয়। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা অজুহাতে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), আনসার বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার হেলমেট কেনা হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পুলিশ বাহিনীর হেলমেট কেনা হয় প্রতিটি ১ হাজার ৪৮০ টাকা দরে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কেনা হয় ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৫০০ পিস ভিআইপি হেলমেট কেনা হয় ১ হাজার ৬৮৭ টাকা দরে। ঠিক পরের অর্থবছরে প্রতিটি হেলমেট কেনা হয় ৯ হাজার ৪২৯ টাকা দরে। দুই অর্থবছরে প্রায় ৪০ হাজার হেলমেট কেনার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা লুটপাট হয়। আর একই মানের বেশ কিছু ভিআইপি হেলমেট দুই অর্থবছরে কেনা হয়। যার প্রতিটি দাম ধরা হয় ১৯ হাজার ৯০০ টাকা।
এই দুই অর্থবছরে পুলিশ বাহিনীর কাপড়, জুতা, গ্রাউন্ডশিট, মোজা, মাল্টিপারপাস বেল্ট এবং হেলমেটসহ সব ধরনের মালামাল সরবরাহ করে জেরিন টেক্স, ম্যাক ইন্টারন্যাশনালসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আগে স্যু-পালিস কেনা হয়েছে প্রতিটি ৩২ টাকা দরে। কিন্তু পরে কেনা হয়েছে প্রতিটি ৬৯ টাকা দরে। আগে যে ক্যানভাস স্যু কেনা হয়েছে ৫০০ টাকা দরে। পরে তা ১ হাজার ২৫০ টাকা করে কেনা হয়েছে। প্রতি জোড়া বুট জুতা কেনা হতো ১ হাজার ২০০ টাকা দরে। পরে তা কেনা হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা ধরে।