সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে এবং ভাতাব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গতিশীল সামাজিক তথ্যভান্ডার তৈরিতে ১৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে অর্থবিভাগ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
এ প্রকল্পটি এমন সময় পাঠানো হলো যখন তিন মাস আগে ৯০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। উল্লিখিত প্রকল্প ব্যয়ের ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ বা ১৯৪ কোটি টাকা পরামর্শক ব্যয় বরাদ্দ রাখার পরও নতুন করে ১৭০ কোটি টাকার কারিগরি সহায়তা প্রকল্প প্রস্তাব করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
অর্থবিভাগ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো প্রাক্কলিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে বিশ্বব্যাংকের ৯৭ কোটি ৫২ লাখ টাকার সহায়তা অন্তর্ভুক্ত করেছে। যা চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অনুমোদিত নয়- এমন প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে, যাতে দ্রুত অনুমোদন পাওয়া যায়। প্রকল্পটি চলতি বছরের জুলাই মাসে শুরু হয়ে ২০৩০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২০০ কোটি টাকার একটি অর্থায়ন চুক্তি সই হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থবিভাগ। যার মধ্যে সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য ৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থবিভাগের প্রকল্প যাচাই কমিটির বৈঠকে এ প্রস্তাব অনুমোদনের পর এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের আন্তমন্ত্রণালয়ে বৈঠকে সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটি এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান। প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রকল্পটির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতাভোগী নির্বাচন ও ভাতাব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং এ প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী করা। এর মধ্যে রয়েছে গতিশীল সামাজিক তথ্যভান্ডার তৈরি; বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তথ্য ব্যবস্থাপনা প্লাটফর্মগুলোর সমন্বয়; ব্যাংক ও মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে পেমেন্ট সংযোগ স্থাপন ও নীতিনির্ধারণে তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করা। এর আগে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে একনেক সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পটি অনুমোদন করে, যার মাধ্যমে ৪৫ লাখ দারিদ্র্য মানুষের মধ্যে ৫৮৯ কোটি নগদ টাকা বিতরণে পরামর্শক সেবায় ১৯৪ কোটি টাকার বেশি ব্যয় পরিকল্পনা করা হয়। এতে দেখা যায়, সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে ১৭৩ কোটি টাকা আর আটজন পরামর্শককে ২১ কোটি ১ লাখ টাকা দেওয়া হবে। ফলে প্রত্যেকের মাসিক বেতন গড়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। অর্থনীতিবিদরা এ খাতে পরামর্শক খরচের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা পরামর্শকদের ভূমিকা স্বীকার করলেও দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী জীবনধারণে হিমশিম খাচ্ছে, তখন সরকারের উচিত প্রতিটি টাকা এমনভাবে ব্যয় নিশ্চিত করা যাতে প্রকৃত উপকারভোগীরাই সর্বোচ্চ সুবিধা পান।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনও একই মত পোষণ করে বলেন, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে বরং উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি বা প্রতিজনের ভাতা বাড়ানো সম্ভব। সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ পরামর্শক ব্যয় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও তিনি নতুন করে আলাদা কারিগরি সহায়তা প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
এর আগেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৩ সালে জাতীয় পরিবারভিত্তিক তথ্যভান্ডার গঠনের জন্য ৬৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০২২ সালে এ প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও, এখনো তা নীতিনির্ধারণ বা লক্ষ্য নির্ধারণে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না।