সোনালি সময়ে একটাই চ্যানেল ছিল বিটিভি। একটার পর একটা মন ভোলানো ধারাবাহিক প্রচার হতো। প্রিয় নাটক ও পছন্দের তারকাদের দেখতে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকত ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনের সামনে। তখনকার নাটকের সংলাপ সবার মুখে মুখে ফিরত, যেগুলোর আবেদন এখনো কমেনি। সেসব সংলাপ এখনো প্রাসঙ্গিক। সোনালি সময়ের তারকাদের মুখে মুখে ফেরা সেসব জনপ্রিয় সংলাপ নিয়ে লিখেছেন - পান্থ আফজাল
খলিল উল্লাহ খান খলিল (সংশপ্তক) : এ নাটকে অভিনেতা খলিল উল্লাহ খানের চরিত্র ফেলু মিয়া। যিনি গ্রামের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। অনেক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী। তাঁর মুখে বিখ্যাত সংলাপ : ‘আমি মিয়ার ব্যাটা, মিয়া’, ‘টাকা আমার চাই, নইলে জমি’।
ফেরদৌসী মজুমদার (সংশপ্তক) : ‘সংশপ্তক’ নাটকে হুরমতি চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে দেশজুড়ে ‘হুরমতি বু’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বরেণ্য অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। এ নাটকে ফুটে উঠেছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষিতা, জেদি, বিদ্রোহিনী, পাল্টা প্রতিশোধপরায়ণ হুরমতির জীবনছবি। হুরমতির মুখে যত সংলাপ, সবই ইতিহাস। যেমন- ‘বেবাক ফাঁস কইরা দিমু’, ‘আরে হুরমতি বলছি তো!’
আলী যাকের (বহুব্রীহি) : খুবই মিস্ট্রিয়াস, অর্ধ প্রকৃতস্থ মামা চরিত্রে ছিলেন আলী যাকের। তাঁকে পাগল বলছে পরিবারের সবাই, অথচ নিজে পাগলের চিকিৎসক হিসেবে কনসালট্যান্সি করছেন। এ নাটকে মামার মুখ দিয়ে বের হওয়া সংলাপ হলো- ‘কথার মধ্যে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না দুলাভাই’, ‘আপনি প্রতিভা চিনতে পারলেন না’, ‘বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না’, ‘পাবলিকের মুখ তো আর বন্ধ করা যাবে না’, ‘ফাজিলের দেশ, সব বর্বর’। তবে এর মধ্যে যে ডায়ালগটা জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয় তা হলো- ‘তুই রাজাকার’।
আবুল হায়াত (বহুব্রীহি) : ‘সোবহান সাহেব’ থেকে ‘সিরিয়াস সমাজসেবী’! ‘হে মাছ’ দিয়ে শুরু হয় সামাজিক আন্দোলন। সোবহান সাহেবের শান্ত ভঙ্গিতে বলা সংলাপগুলো ছিল যেন গরম চায়ের কাপে চিনির ছিটা, ধীরে ধীরে মিষ্টি হয়ে উঠত! তার মুখে বিখ্যাত সংলাপ- ‘বহিষ্কার হও’।
হুমায়ুন ফরীদি (সংশপ্তক) : ‘সংশপ্তক’ নাটকে হুমায়ুন ফরীদি যখন কাঁচা মাটির গন্ধ মেখে এসে ‘কানকাটা রমজান’ হয়ে পর্দা কাঁপালেন তখন দর্শক কান দিয়ে শুনলেন, মন দিয়ে ভালোবেসে ফেললেন। তাঁর অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি, গলা উঁচিয়ে সংলাপ বলা আর সেই ভয়ংকর কিন্তু মায়া ভরা হাসি আজও দর্শকদের নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে রাখে। কানকাটা, কিন্তু জনপ্রিয়তায় কান ফাটানো! ‘আমি কানকাটা রমজান!’-শুধু একটা সংলাপেই চমকে উঠেছিল দেশ। ‘ওসি সাহেবকে আমি সামলাবো। আমার নাম হচ্ছে কাজী মোহাম্মদ রমজান’-এটিও জনপ্রিয় ছিল এ নাটকের। ‘আমি তো জমি কিনি না, ফানি কিনি’-ভাঙনের শব্দ শুনি নাটকের এ সংলাপটিও জনপ্রিয়।
খালেদ খান (রূপনগর) : ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ‘রূপনগর’ টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে আরও একটি সফল, আলোচিত এবং জনপ্রিয় নাটক। নাটকটিতে যুবরাজ খালেদ খানের মুখে ‘ছি ছি ছি তুমি এত খারাপ’ কিংবা ‘ছি ছি ছি মাস্তানরা এত খারাপ’ সংলাপ সে সময় ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখানে অভিনয় করে অনেক শিল্পীই তারকা বনে যান।
মাহমুদা খাতুন (বহুব্রীহি) : এ নাটকে রহিমার মা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাহমুদা খাতুন। তাঁর মুখে কিছু সংলাপও জনপিয় হয়েছিল। যেমন- ‘আমারে একটা ছবি তুলে দিবেন? বিলিক ইন হুয়াইট!’, ‘মানুষের স্বাদ-আহ্লাদ বলে কি কিছু নাই?’
আমিরুল হক চৌধুরী (নিমফুল) : হুমায়ূন আহমেদের ‘নিমফুল’ নাটকের আমিরুল হক চৌধুরীর সেই বিখ্যাত সংলাপ, যা এখনো সমান জনপ্রিয়। সংলাপটি হলো-‘সে এক বিরাট ইতিহাস’।
তারিক আনাম খান (বারো রকমের মানুষ) : এ নাটকে তারিক আনাম খানের বিখ্যাত সংলাপ- ‘থামলে ভালো লাগে’ আজও মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়।
আসাদুজ্জামান নূর (বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই) : ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের ঐতিহাসিক চরিত্র বাকের ভাইয়ের মুখের সব সংলাপই দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সে সময় তাঁর মুখে সংলাপ ছিল- ‘মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে!’, ‘কথা বলবে না। কথা কম কাজ বেশি’, ‘গোফ অফ কইরা দে’। অন্যদিকে করেছেন নান্দাইলের ইউনূস চরিত্র। গ্রামগঞ্জের রহস্যময় চরিত্রের এক লোক। মাথায় হনুমান টুপি। গলায় মাফলার। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি কে? গম্ভীর মুখে ইউনূস উত্তর দেন- ‘আমি কেউ না’। তার একটি বিখ্যাত ডায়ালগও ছিল- ‘অসুন্দর হয় মানুষ’।
আবদুল কাদের (কোথাও কেউ নেই) : এ নাটকে বদি চরিত্রের ভাইরাল সংলাপগুলো বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে একেকটা ক্ল্যাসিক লাইন। যেমন- ‘বাকের ভাই অনেক বড় পোলা, কিন্তু আমি কোনো ছোট পোলা না!’, ‘আমি যা বলি তাই করি, আর যা করি সেটা বলে করি না।’, ‘আমি বদি, কারও বাপরে ভয় পাই না!’, ‘চেহারার দিকে না তাকিয়ে কাজের দিকে তাকান!’, ‘আমি ল্যাংড়া হইতে পারি, কিন্তু বেকুব না।’, ‘বকবক করিস না, গলা টিপে ধরুম।’
আফজাল শরীফ (‘বহুব্রীহি) : ‘বহুব্রীহি’ নাটকের কাজের ছেলে কাদের চরিত্রে আফজাল শরীফ নিজেকে এমনভাবে ঢেলে দিয়েছিলেন যে, নিজের নামটাই হারিয়ে গেল, তিনি হয়ে গেলেন ‘কাদের’। তার মুখের সেই বিখ্যাত সংলাপ- ‘আমি সৈয়দ বংশের ছেলে’। ‘কামিং স্যার’, যেই সংলাপটি একটা কমেডি নয়, একটা ক্লাসিক। ‘চশমাটা বড়ই সৌন্দর্য’, ‘টেকা পয়সাই কি জীবনের সব?’, ‘আমি চোর না, স্যার!’ সংলাপগুলো আজও অমলিন।
জাহিদ হাসান (আজ রবিবার) : হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত নাটক আজ রবিবার। সেই নাটকে আনিস চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জাহিদ হাসান। তাঁর মুখের সংলাপগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল। যেমন : ‘আশ্চর্য! মেয়েটা রেগে গেল কেন?’, ‘তিতলী ভাইয়া, কংকা ভাইয়া’, ‘কংকা ভাইয়া, আমাকে এক গ্লাস পানি এনে দাও তো, নরমাল’, ‘হিজিবিজি, হিজিবিজি! এবং হিজিবিজি’, ‘ক্যাঁকো ক্যাঁকো, ক্যাঁকো কেকো’।
ফারুক আহমেদ (আজ রবিবার) : এ নাটকে মতি চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন ফারুক আহমেদ। তাঁর মুখের বিখ্যাত সংলাপ, ‘অধিক কথায় সার্থকতা নেই। মতি মিয়া অধিক কথা পছন্দ করে না।’, ‘আমরা কি পানি পাব?’, ‘বৃক্ষ মানব’ এর ‘গাঞ্জা খেয়ে কুল পাই না, লেখাপড়া করবো কখন?’
আরও যেসব সংলাপ :
আজ রবিবার নাটকের ‘গড কি তোর একার নাকি, বল আওয়ার গড’, ‘তোকে কফিনে শুইয়ে ডালাটা বন্ধ করে রাখা দরকার’, ‘মেয়েদের ধর্ম হলো তারা যাকে লাইক করে তাকে খুব যন্ত্রণা দেয়’, অয়োময়-এর ‘আমার নাম কমলা, চেহারা সুন্দর তো, তাই সবাই ডাকে কমলা সুন্দরী’, কোথাও কেউ নেই নাটকের ‘কুকুররে কুত্তা কইলে, কুকুর মাইন্ড করে’, বুয়া বিলাস নাটকের ‘কিছু দোয়া-কালাম পড়েছিলাম। আপনাকে একটা ফুঁ দেই?’ উড়ে যায় বকপক্ষী নাটকের ‘ইয়া মুকাদ্দিমু বলে ডান পা আগে বাড়াও’, ‘জগৎটা বড়ই অদ্ভুত’ (নক্ষত্রের রাত), ‘আমি কান্দনের ধার ধারি না, আমি প্রেসিডেন্ট বুশ’ (চৈত্র দিনের গান), ‘দুবাই যামু, ট্যাকা দেও। ট্যাকা দেও, দুবাই যামু (জব্বর আলী), আপনি হলেন গিয়ে বটবৃক্ষ (সংশপ্তক), এম এ পাস, ফাস্ট্ট ক্লাস, ‘কোইতর ডাবের ভিতর পাগলা পানি ভর’ (মাটির মায়া), রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি সামাজিক বিজ্ঞান (কেরাম), ‘লীলেখেলা চলতিছে’, ‘ঢোল আর নারী দুটাকে মারের ওপর রাখতে হয়’ (অয়োময়), ‘মির্জা বাড়ির এক সুতায় টান দিলে দশ সুতায় নড়ে’ (অয়োময়), ‘হাসতে পারলাম না বলে দুঃখিত’ (বহুব্রীহি), ‘মারো চিকা মারো’, ‘ফুইট্রা কইরা দিমু কইলাম’ প্রভৃতি।