‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দে ছাড়িয়া, বন্দি হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে, কান্দে রইয়া রইয়া’... এই আকুতি কদম সারেংয়ের। দীর্ঘদিন পর জাহাজের চাকরির ছুটিতে তার প্রিয়তমা স্ত্রী নবীতুনের কাছে ফিরছেন কদম, সময়ের বাঁধ যেন বড়ই শক্ত, কখনো জাহাজ, কখনো ট্রেন, কখনোবা নৌকায় চড়ে নবীতুনের পানে ছুটে চলেছেন সারেং। কণ্ঠে তার আকুতি আর মিলনের গান...‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া মরি আমি ধড়ফড়াইয়া, একলা ঘরে মনুয়া বধূ হায়রে কী জানি কী করে...।’ ১৯৭৮ সাল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ও নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করলেন ‘সারেং বৌ’ চলচ্চিত্রটি। এতে কদম সারেংয়ের চরিত্রে জনপ্রিয় অভিনেতা ফারুক আর নবীতুনের ভূমিকায় অভিনয় করেন মিষ্টি মেয়ে কবরী। চলচ্চিত্রটির মতো এর গানগুলোও ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে এই চলচ্চিত্রের ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি কোনো দিনই ভুলতে পারবে না শ্রোতারা। গানটি গেয়েছিলেন আরেক বিখ্যাত শিল্পী আবদুল জব্বার। আর এই গানটি আবেগতাড়িত করেছিল এক সুইডিশ তরুণীকে। এ ছবিতে অসাধারণ সংগীতায়োজন করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন কিংবদন্তি সুরকার আলম খান। গীতিকার মুকুল চৌধুরী এবং আরেক কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আবদুল জব্বারসহ একাধিক সংগীতজ্ঞের পরিশ্রমে সৃষ্টি করা কালজয়ী গান ‘ওরে নীল দরিয়া’ এখনো কোটি দর্শকের চোখের কোণে অশ্রু এনে দেয়। আলম খান তার জীবদ্দশায় এ গান সৃষ্টির পটভূমি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গানটির অস্থায়ী সুরটা তার ১৯৬৯ সালে করা। ১৯৬৯ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, একদিন বিকালে যখন একটু সুস্থ হলেন, গুনগুন করে সুরটা তার মাথায় আসে। কিন্তু তখন সুরের ওপর কথা লেখা হয়নি। তিনি সে সময় মনের মতো কোনো দৃশ্য না পাওয়ায় কোনো ছবিতে সুরটি ব্যবহার করতে পারেননি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সেই সুযোগ এলো- ‘সারেং বৌ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে আলম খানের কাছে এলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন ‘সারেংবৌ’ ছবির গল্প নিয়ে। সারেং বাড়ি ফিরছে, এ রকম একটি সিকোয়েন্স পরিচালক তাকে
শোনান। ওইখানে দেখা যাবে, সারেং গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে, আর তার স্ত্রী নবীতুন সেটি স্বপ্নে দেখছেন। তখন তিনি গানটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে রাখা সেই সুরটি গীতিকার মুকুল চৌধুরীকে শোনান। মুকুল চৌধুরী গানের সুরের সঙ্গে ভালো গীত বসাতে পারেন, তখন তিনি সুরের ওপর ‘ওরে নীল দরিয়া’ পুরো মুখটি লিখেন। এর দুই দিন পর গল্প অনুযায়ী অন্তরাসহ-ই লিখে নিয়ে এলেন। অন্তরাটি সবার অনেক পছন্দ হয়, আলম খান এরপর তার কথার ওপরই সুর করেন। আলম খান পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে জানতে চাইলেন, সারেং কীভাবে বাড়ি ফিরছে। তখন তিনি বললেন, প্রথম অন্তরায় ট্রেনে, দ্বিতীয় অন্তরায় সাম্পানে, এরপর মেঠোপথ ধরে বাড়ি ফিরবে। দৃশ্য অনুযায়ী ট্রেনের ইফেক্ট, সাম্পান, বইঠা, পানির ছপছপ শব্দ এবং শেষে একতারার ইফেক্ট তৈরি করা হলো এবং এগুলো সবই ছিল বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন আসবাবপত্র দিয়ে বানানো। যেমন তিনি রেললাইনের সাউন্ড তৈরির জন্য খাঁজকাটা কাঠের টুকরা ব্যবহার করেছেন, বৈঠা বাওয়ার আওয়াজ তৈরিতে পাটকাঠি ব্যবহার করেছেন, বৈঠা বেয়ে বেয়ে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন সাউন্ড তৈরির জন্য পানিভর্তি চাড়ি (গরুর পানি খাওয়ার পাত্র) ব্যবহার করেছেন। এসব কাজ করা হয়েছে তিনটি মাইক্রোফোনের সহায়তায়, মোট ১২ জন্য শিল্পী এই রিদমিক সেকশনে কাজ করেছিলেন। ছিলেন ১০ জন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী। গানটি কাকে দিয়ে গাওয়ানো যায়, আলম খান যখন ভাবছিলেন, তখন আবদুল্লাহ আল-মামুনই আবদুল জব্বারের কথা বলেন। গানটি কাকরাইলের ঈপ্সা রেকর্ডিং স্টুডিওতে সকাল ১০টায় রেকর্ড শুরু হয়, শেষ হয় বিকাল ৫টায়। আবদুল জব্বার বলেছিলেন, তার গাওয়া সেরা
তিনটি গানের মধ্যে এটি ছিল প্রথম। এদিকে, ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর আরটিভির বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়ার আয়োজনে স্বর্ণযুগের সেরা ১০টি গানের মধ্যে এই গানটি প্রথমস্থান অধিকার করে। গানটির চিরন্তন আবেদন আবেগপ্রবণ করেছিল সুদূর সুইডিশ এক তরুণীকেও। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় সুইডিশ কণ্ঠশিল্পী জয়ই প্র্যাঙ্কস। ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি এটি তুলেছেন ইউটিউবে। আর তখন এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে অন্তর্জাল দুনিয়ায়।