গত বছর জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। ঘটনার সময় মামলার সব আসামিই ডিএমপিতে ছিলেন। পাঁচ আসামির মধ্যে চারজনই পলাতক। তারা হলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির খিলগাঁও জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমান ও একই থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) তুরিকুল ইসলাম ভূইয়া। আর আসামি চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে গত ২৬ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২৮ জানুয়ারি তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করলে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।
গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। অন্যদিকে অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতির বিষয়ে আংশিক শুনানি হয়েছে। আগামী রবিবার বাকি শুনানি শেষে ১৬ সেপ্টেম্বর আদেশের কথা জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
আদালতে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। পলাতক আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। গ্রেপ্তার আসামি চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান নিপ্পন।
শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর আসামিদের সংঘটিত অপরাধের বর্ণনা তুলে ধরেন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার আরজি জানান ট্রাইব্যুনালের কাছে। বিপরীতে মামলার অভিযোগ থেকে পলাতক আসামিদের অব্যাহতি চান তাদের আইনজীবী আমির হোসেন। আসামি চঞ্চল চন্দ্র সরকারেরও অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছেন তার আইনজীবী। ১৪ সেপ্টেম্বর এ আবেদনে শুনানির পর ১৬ সেপ্টেম্বর আদেশ দেবেন ট্রাইব্যুনাল। পরে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আশা করছি আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হবে।
গত ১০ আগস্ট এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ গঠনের শুনানির একপর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর জানান, পলাতকদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। গত ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। যাচাইবাছাইয়ের পর গত ৭ আগস্ট তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়। হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।
যে তিন ঘটনায় মামলা : গত বছরের ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। রাজধানী রামপুরা এলাকায় তখন পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। এর থেকে বাঁচতে তিনি নির্মাণাধীন ওই ভবনের চারতলায় গিয়ে আশ্রয় নেন। একপর্যায়ে আন্দোলকারীদের ধাওয়া করে পুলিশ ভবনটিতে উঠে যায়। ভয়ে কার্নিশের রড ধরে নিচে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন আমির হোসেন। তখন এক পুলিশ সদস্য ঝুলতে থাকা আমির হোসেনকে ছয়টি গুলি করেন। সবকটি গুলি তার পায়ে লাগে। পরে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় লোকজন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আমির হোসেন।
রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকায় বাসার নিচের দোকান থেকে সাত বছরের নাতি বাসিত খান মুসাকে আইসক্রিম কিনে দিতে যান দাদি মায়া ইসলাম (৬০)। এ সময় তার পেটে এবং মুসার মাথায় গুলি লাগে। মায়া ইসলাম পরদিন মারা যান। মুসাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা দেওয়া হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় মুসাকে সিএমএইচ থেকে গত বছরের ২২ অক্টোবর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে পাঠায় সরকার। ৫ মাস ১২ দিন পর গত ৪ এপ্রিল দেশে আনা হয় শিশুটিকে। বেঁচে গেলেও শিশুটি কথা বলছে না বলে সাংবাদিকদের জানান প্রসিকিউটর তামীম।
গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসায়ী নাদিম মিজান স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বনশ্রী এলাকায় থাকতেন। গত বছর ১৯ জুলাই জুমার নামাজ পড়তে বাসা থেকে বেরিয়েই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। ওইদিন রাতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।