চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের প্রধান ফসল ধান। এ ফসলের ওপরই নির্ভর করে বেঁচে থাকে এলাকার হাজার হাজার কৃষক। ঋণ-ধার করে অর্থের জোগানোর পাশাপাশি হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর ঘাম ঝড়িয়ে ফসল ফলিয়ে থাকে। উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার পর ফসলের যদি ন্যায্য দাম কৃষক না পায় তবে তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। দিশেহারা হয়ে পড়ে কৃষক। গত বছরের ন্যায় এবারও কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঋণ-ধার ও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কোন সুফল পাচ্ছে না কৃষকেরা। অনেকে ঋণের চাপে দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। ব্যয়ের সাথে আয়ের সমন্বয় করতে না পারে ধানের বদলে এবার পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বিশেজ্ঞদের মতে ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহ ধরে রাখতে সরাসরি ধানচাষী কৃষকদের ভর্তুকি ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ন্যায্যমুল্যে ধান কেনার ঘোষণা দিলেও সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে এবারও কৃষকরা বঞ্চিত হওয়া আশঙ্কা করছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলার নয়টি উপজেলায় ১লক্ষ ৪০হাজার ৮শত ৫৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়। লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫লাখ ৪৫ হাজার ৭শত ৬০ মে.টন চাউল। এ পর্যন্ত ৭২% জমিতে ধান কাটা হয়েছে। পুরো কাটা শেষ হলে এবার জেলায় ৫লাশ ৯৫ হাজার ৮১৬ মে.টন চাল উৎপাদন হবে।
তাড়াশ উপজেলার কৃষক নওশের হোসেনসহ অনেকে জানান, অঞ্চলভেদে এক বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করতে বীজতলা থেকে শুরু করে সার-কীটনশাক, ধানকাটা ও মাড়াই ও শ্রমিকসহ খরচ প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার। ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতি না হলে প্রতিবিঘায় অন্তত ১৮ থেকে ২০ মন ধান উৎপান হয়। আর বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে সর্বোচ্চ ৫৬০ টাকা। এ হিসেবে একজন কৃষকের বিঘা প্রতি গড়ে লোকসান হচ্ছে প্রায় ৫-৭ হাজার টাকা।
চলনবিলের মাগুড়া বিনোদ ইউপি দোবিলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এম রহমতুল্লাহ জানান, এবার ৪০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় প্রায় ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিঘাপ্রতি গড়ে ২০ মণ ধরে ধান হয়েছে। বাজারের ধানের দাম ৫শ' টাকা মণ। এ হিসেবে এবার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
মাছুয়াকান্দি গ্রামের কৃষক শামসুল আলম জানান, ১৩ বিঘা জমিতে ধান করা হয়েছে। প্রতি বিঘায় প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধানের দাম না থাকায় যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তা কিভাবে পুষিয়ে নিবো সে চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছি।
ধুবিল গ্রামের কৃষক রুবেল জানান, ১৬ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। বিক্রি করে যে দাম পেয়েছি তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। শুধু খড়কুটোই লাভের অংশে থেকে যাচ্ছে। এদিকে, সরকারীভাবে ৫ মে থেকে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনও কোন ধান সংগ্রহ করা শুরু হয়নি। কৃষকরা পাওনাদারদের চাহিদা মেটাতে অল্পদামেই ধান বিক্রি করে দিচ্ছে। আর এ সুযোগে কিছু মৌসুমে ব্যবসায়ী অল্প দামে কিনে তা মজুদ করে রাখছে। সরকারীভাবে সংগ্রহ শুরু হলে তারা সেগুলো কৃষক সেজে বিক্রি করে লাভবান হয়।
কৃষক ও কৃষি নিয়ে কাজ করার স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার ডিডিপির পরিচালক কাজী সোহেল রানা জানান, প্রতিবছর ধানে লোকসান দিতে দিতে কৃষক সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে কৃষকরা ধান চাষ থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ইতোমধ্যে অনেক এলাকায় ধানের বদলে পাট চাষাবাদ শুরু করে দিয়েছে। তার মধ্যে কৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে উৎপাদন খরচের সাথে সমন্বয় করে একটি মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি সরকারকে সরাসরি ধানচাষীদের বিঘাপ্রতি ভর্তুকি প্রদান করতে হবে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম জানান, এবার জেলায় কৃষকদের কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭শ' মে.টন ধান সংগ্রহ করা হবে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার লক্ষ্যে গত ৫ মে থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উপজেলাগুলোতে মিটিং ও মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই গুদামে ধান নেয়া হবে। তবে কোন সিন্ডিকেট নয় সরাসরি যাতে কৃষক ধান দিতে পারে সে ব্যাপারে বিশেষ নজর থাকবে।
সিরাজগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ওমর আলী সেখ জানান, লক্ষ্যমাত্রার বেশি জমিতে বেশী পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করা হয়েছিল। উৎপাদন ভাল হয়েছে। এবারও বিক্রয় মুল্যের চেয়ে কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষকদের বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। তবে কৃষি বিভাগ কম খরচে ভাল ফলনের জন্য কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শ প্রদান অব্যাহত রেখেছে।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৬ মে, ২০১৬/ আফরোজ