যমুনার নদীর পানি সিরাজগঞ্জে পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৯ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৫টি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে। বসতবাড়ি প্লাবিত হওয়ায় দুর্বিসহ জীবন কাটছে বানভাসীদের। চুলো জ্বলছে না অনেক পরিবারে। খেয়ে না খেয়ে চলছে তাদের জীবন। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। উঁচু জায়গা না থাকায় নৌকায় খোলা আকাশের নীচে কাটছে অনেকের সংসার। গবাদিপশুর সাথে এক ঘরে রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের। দুর্গম অঞ্চলগুলোতে এখনো পৌছেনি সরকারি ত্রাণ সহায়তা। যা দেয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছে বানভাসীরা। শরীরে ঘা-চুলকানিসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা। কাজিপুরের নতুন খাসরাজবাড়ী গ্রামটি প্রায় ১৫ দিন যাবৎ পানির নীচে তলিয়ে গেলেও এখানে কোন সরকারি সহায়তা পৌঁছেনি। এ গ্রামের কিছু কিছু মানুষ নৌকা খোলা আকাশের নীচে দিনযাপন করছে।
নতুন মাইজবাড়ীর চরে আধো ডুবো একটি ছোট্ট ওয়াপদার বাঁধের পাশে বেঁধে রাখা নৌকার উপর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জ্যোতি চাকলাদার বলেন, ''আইজ ৮ দিন ধইর্যা নায়ের উপর আছি। নায়েই রান্দা, নায়েই খাওয়া, আবার নায়েই শোয়া, এভাবেই চইলত্যাছে আমগোরে জীবন। বানের পানিতে বাড়ি-ঘর ডুইবা গেছে, আশ্রয় কেন্দ্রেও থাকার জায়গা পাই নাই, কোনঠে যামু ? তাই প্রতিদিন ৭ থেকে ৮শ' টাকার করে নৌকা ভাড়া নিয়া এহেনেই বউ ছওয়ালপাল নিয়া কুনমতে বাইচা আছি।''
নৌকায় আশ্রয় নেয়া রুস্তুম খা, আব্দুস সালাম, বাবলু, সাঈদ, ইসমাইল ও আলমানি আকন্দ জানান, ৮/৯ দিন ধরে যমুনার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন মাইজবাড়ী, খাসরাজবাড়ী, চর বুরুঙ্গী, উজান মেওয়াখোলা, ভাটি মেওয়াখোলা, মাইজবাড়ী, ঢেকুরিয়াসহ চরাঞ্চলের অর্ধশতাধিক গ্রাম পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। প্রথম ঘরে বাঁশের মাচা তৈরি করে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু ধীরে ধীরে বাঁশের মাচাও ডুবে যায়।
গ্রামের রাশিদা খাতুন জানান, রান্না করার জায়গা নেই। দিনে একবার পাক করা হয়। আর বাকী সময় না খেয়েই থাকতে হয়। জায়গা না থাকায় গরু-ছাগলের সাথে এক ঘরেই রাত কাটাতে হয়।
হযরত আলী জানান, কারও দুদিন, কারও একদিনের খাবার আছে। অনেকের খাবার সংকটের কারণে অন্যের কাছে ধার করতে হচ্ছে। এত কষ্ট স্বত্বেও এইসব অঞ্চলে এখনও সরকারী-বেসরকারী কোন ত্রাণ পৌঁছেনি বলে জানান নৌকার উপর আশ্রয় নেয়া বানভাসী মানুষেরা।
নতুন মাইজবাড়ী এলাকার সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য লতা খাতুন জানান, অন্যান্য এলাকায় ত্রাণ দিলেও এ অঞ্চলে এখনো কিছুই দেয়া হয়নি। আমরা চাহিদা দিয়েছি। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা চলে আসবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ওয়ালী উদ্দিন জানান, এ পর্যন্ত ১৩ লক্ষ টাকা ও ৩৭০ মেট্রেক টন চাল বিতরণ ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকলকে ত্রাণের আওতায় নানা হবে।
বাঁধ ভাঙ্গা আতঙ্কে রাত জেগে পাহারা:
সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বিকল্প বাঁধ চুয়ে বন্যার পানি আসার পর থেকে ভাঙ্গন আতঙ্কে রয়েছে শহরবাসী। এ বাঁধটি যাতে কোনক্রমে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেজন্য রাত জেগে পাহারা বসানো হয়েছে। শুক্রবার সাড়ে ১১টার দিকে শহরের রানীগ্রাম-পাঁচঠাকুরী শহর রক্ষা বিকল্প বাঁধটির রানীগ্রাম অংশে প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে পুলিশ ও এলাকাবাসীর সমন্বয়ে পাহারা দিতে দেখা যায়। এছাড়াও বাঁধটির উপরে বালির বস্তাসহ ভাঙ্গন ঠেকানোর সকল আসবাবপত্র রেখে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সদর থানার উপ-পরিদর্শক ঘটনাস্থল থেকে জানান, এখানে পৌরসভার পক্ষ থেকে ৩৫ জন স্থানীয় লোক পাহারার জন্য রাখা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ সার্বক্ষণিক টহলে রয়েছে।
স্থানীয় কাউন্সিলর গোলাম মোস্তফা বলেন, ৩৫ জন লোক সার্বক্ষণিক পাহারার জন্য রেখেছেন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এখানে রাখা হয়নি।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান ইমাম জানান, বর্তমানে নদীর পানি বিপদসীমার ৮৯ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়া শহর রক্ষা বিকল্প বাঁধটি সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/৩০ জুলাই, ২০১৬/মাহবুব