সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে গার্মেন্টেসের পরিত্যক্ত টুকরো ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে হরেক রকম শীতবস্ত্র। মান ভালো ও দামে কম হওয়ায় চাহিদা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে এসব শীতবস্ত্রের। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি এখানকার তৈরী কম্বল ভারতেও চলে যাচ্ছে। আর নিজ বাড়ীতে বসে কম্বল তৈরী করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে এলাকার প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ও অনেক দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, উপজেলার বরশীভাঙ্গা গ্রামের সাইদুল ইসলাম তাঁত শ্রমিকের কাজ করতেন। সামান্য আয়ে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। ভাগ্যের চাকা ঘোড়াতে নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন। একবার ঢাকায় গিয়ে দেখতে পান গার্মেন্টেসের ছোটছোট ঝুট কাপড় ফেলে দেয়া হচ্ছে। সেলাইয়ের কাজ জানা থাকায় ২৭ বছর আগে সাইদুল অন্যের কাছ থেকে ৭শ' টাকা ধার নিয়ে কিনে আনেন টুকরো কাপড়গুলো। তৈরি করতে শুরু করেন জোড়া তালির কম্বল।
৭০ থেকে দেড়’শ টাকায় বিক্রি শুরু করেন ওগুলো। মান ভালো হওয়ায় কম্বলগুলো দরিদ্র মানুষের কাছে তারাতাড়ি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে তার সাথে দু'একজন এ কাজে জড়িত হলেও বর্তমানে ছোট-বড় প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ী কম্বল তৈরির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা ঢাকা থেকে ঝুট কাপড় কিনে এনে এলাকার দরিদ্র নারীদের হাতে তুলে দেন। তারা সেলাই মেশিনে ছোট ছোট টুকরোগুলো জোড়া দিয়ে বাহারী রংয়ের কম্বল তৈরি করেন। কম দামে মানসম্মত পণ্য হওয়ায় উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান এমনকি ভারতেও এসব কম্বল চলে যাচ্ছে।
বর্তমানে কাজীপুর উপজেলার পলাশবাড়ী, চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের শিমুলদাইড়, চালিতাডাঙ্গা, বরশীভাঙ্গা, মাধবডাঙ্গা, হরিনাথপুর, বেলতৈল, শিমুলদাইড়, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, বরইতলা, মসলিমপাড়া, মানিকপটল, বরশীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, গাড়াবেড়, রশিকপুর, হরিনাথপুর, ভবানীপুর, মাথাইলচাপর, রৌহাবাড়ী, পলাশপুর, বিলচতল, চকপাড়া, লক্ষীপুর, বেলতৈল, চকপাড়া, চালিতাডাঙ্গা, কবিহার ও হাটশিরা, মাইজবাড়ী ইউনিয়নের মাইজবাড়ী, গান্ধাইলসহ আশপাশের প্রায় ৫০টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার নারী পুরুষ স্বাবলম্বী হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি চার-পাঁচ হাত লেপ বানাতে খরচ হয় ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। অথচ সেখানে একই সাইজের একটি কম্বল ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। টুকরো টুকরো ঝুট জোড়া দিয়ে বানানো ঝুট কম্বল যেমন হালকা তেমন বেশ গরম ও আরামদায়ক। ঝুট কাপড়ের বেশি জোড়া পড়লে প্রায় পাঁচ কেজি ঝুটের প্রয়োজন পড়ে একটি কম্বল তৈরিতে।
ব্যবসায়ী সজিব আহমেদ বলেন, গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কারখানা থেকে টুকরা ঝুট কাপড় কিনে আনা হয়। এসব টুকরা কাপড় মণ প্রতি ৭০০ থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত কিনে আনতে হয়। প্রতি মণ কাপড় থেকে ৫০-১০০টি কম্বল তৈরী হয়। প্রকারভোদে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০ হাজার টাকায় কম্বল বিক্রি করা হয়। যা বাইরে থেকে কিনতে ৫ হাজার টাকা লাগে।
কম্বল শ্রমিক ইব্রাহিম ও এরশাদ মিয়া জানান, দিনে কম্বল তৈরি করে প্রায় ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা আয় করতে পারি। সংসারের কাজের ফাঁকে স্ত্রী সন্তনরাও কম্বলের কাজ করে আয় করতে পারে।
গৃহবধূ আকলিমা খাতুন ও সুরাইয়া খাতুন জানান, দিনে ৪-১০টি পর্যন্ত কম্বল তৈরী করা যায়। এতে এক থেকে দেড়শ' টাকা আয় হয়। তা দিয়ে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ বহন ও সঞ্চয় করা হয়। আর পুরুষদের আয় দিয়ে সংসার চালানো হয়। এতে মোটামুটি ভালই লাভবান হওয়া যাচ্ছে। শুধু গৃহবধুরাই নয় স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা অবসর সময়ে কম্বল তৈরীর কাজ করে তাদের খরচ বহন করছে।
ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম সোহেল জানান, কম্বল ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের নজর না থাকায় তারা নানা সমস্যায় পড়ছে। প্রতি বছর শত কোটি টাকার লেনদেন হলেও এখানে নেই কোন ব্যাংক। সরকার থেকে দেয়া হয় না কোন স্বল্প সুদে ঋণ। যে কারণে বিভিন্ন সংস্থা থেকে বেশী সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন। স্বল্প সুদে ঋণ এবং কম্বলগুলো সরকারিভাবে যদি শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয় তবে এ ব্যবসার আরো প্রসার ঘটবে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
কাজিপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বকুল সরকারের কাছে কম্বলকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে বলেন, এটি কাজিপুরের মানুষের ভাগ্য বদলে বড় ভুমিকা রাখছে। শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেলে ব্যাংক থেকেও ব্যবসায়ীরা নানান সুযোগ পাবে। এতে ব্যবসার প্রসার ও বেশী মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দীকা এটিকে সম্ভাবনায় শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করে জানান, ব্যাংক স্থাপন, স্বল্পসুদে ঋণ ও বাজারজাতকরণে সার্বিক সহযোগিতা ও সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রীর হিসেবে যে কম্বল ক্রয় করা হয় সে ব্যাপারে সরকারের দপ্তরে পত্র দেয়া হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/৩ জানুয়ারি ২০১৮/হিমেল