তার চোখ নেই। তবুও তিনি চালাতে পারেন মোবাইল, কম্পিউটার। কম্পিউটার ব্যবসা করেই নিজের দিন ফিরিয়ে এনেছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শাহরিয়ার ইসলাম সজীব। অদম্য ইচ্ছাশক্তি দৃষ্টিহীন সজীবকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চোখে না দেখলেও মনের সাহসে তিনি শুরু করেছেন মাল্টিমিডিয়ার ব্যবসা। সজিব দৃষ্টিহীন হয়েও যান্ত্রিক কণ্ঠের সহযোগিতায় কম্পিউটার পরিচালনা করছেন। কম্পিউটার পরিচালনা করে দৃষ্টিহীন সজীব পেয়েছে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা।
জানা যায়, বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার পৌর শহরের নতুন বাজার এলাকার রেজাউল করিমের ছেলে সজীব। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার মালাহল এলাকায় শাহরিয়ার ইসলাম সজীবের ‘এস আর টেলিকম’ নামে মাল্টিমিডিয়া প্রতিষ্ঠান।
সজীবের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, এখন অবসরে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সজীব। ছোট দুই ভাই ও বোন স্কুলে পড়ে। জন্মের পর থেকে এক চোখে পৃথিবীর আলো দেখেননি সজীব। একটি চোখের উপর ভরসা করে চালিয়ে নিতে পারতেন সকল কাজ। লেখাপড়া, খেলাধুলা ও প্রয়োজনীয় সকল কাজই করতেন অন্য আরো দশজনের মতোই। দশ বছর বয়সী সজীব যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন, ঠিক তখন সহপাঠীদের সাথে একদিন খেলতে যান মাঠে। ক্রিকেটের বল এসে লাগে তার সচল চোখটিতে। এতে সাড়া জীবনের জন্য পৃথিবীর আলো দেখা থেকে বঞ্চিত হন তিনি।
বহু চিকিৎসা করেও আর দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হয়নি সজীবের। দু’চোখের আলো নিভে গেলেও চেতনার আলো জ্বলছিল তার ভেতরে। সেই আলোয় আলোকিত হওয়ার স্বপ্ন সজীবের। দৃষ্টিহীন সজীব হন পবিত্র কোরআনের (৫ প্যারার) হাফেজ। এরপর তিনি সান্তাহার পৌর শহরের লকোসেট জামে মসজিদে কিছুদিন মোয়াজ্জিন ও পরে ঈমামতি করেন। সেখানে সর্বশেষ তার বেতন ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা। বছর খানেক আগে কম্পিউটার সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিতে তিনি সান্তাহার ডিজিটাল পোস্ট অফিসে ৬ মাস মেয়াদী কোর্সে (প্রশিক্ষণ) ভর্তি হন। সেই ট্রেনিং শেষে তিনি একটি মাল্টিমিডিয়ার দোকান দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু অর্থের অভাবে সেই অসাধ্যকে সাধন করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।
অবশেষে তার মা তাসলিমা বানু তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পত্তি (জমি) বিক্রি করে ছেলের হাতে দুই লাখ টাকা তুলে দেন। সেই টাকায় সজীব ব্যবসা শুরু করেন। দৃষ্টিহীন সজীব এখন তার দোকানে মাল্টিমিডিয়ার কাজের পাশাপাশি ই-পাসপোর্টের আবেদন, ভিসা প্রসেসিং ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের আবেদন ফি জমা, ই-টিন সার্টিফিকেটের আবেদন, এনআইডির আবেদন ও সংশোধন, বিদ্যুৎ বিল জমা ও ফ্লেক্সিলোড দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম রকি জানান, প্রতিটি কাজের পেছনেই তীব্র ইচ্ছা থাকা দরকার। ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে সফলতা সুনিশ্চিত। ইচ্ছাশক্তির বলেই যেকোনো অসাধ্য সাধন করা যায়। সজীব তেমনই একজন। সে দৃষ্টিহীন হলেও স্বাভাবিক আরও দশজনের মতো কম্পিউটার ও মোবাইল চালাতে পারে। আমরা চাই সজীবের ব্যবসা সম্প্রসারণ হোক।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শাহরিয়ার ইসলাম সজীব জানান, দোকান চালুর পর আট মাস অতিবাহিত হলো। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় অনেক খদ্দের আমার দোকানে আসতে চায় না। কিন্তু আমি খদ্দেরদের বলতে চাই আমার ওপর শতভাগ ভরসা রাখতে পারেন।
কম্পিউটারে কাজ করতে কোনো সমস্যা হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইন্টারনেট ভিত্তিক কোনো কাজ করতে গেলে ভেরিফিকেশন কোড নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্তু খদ্দেরদের সহযোগিতা নিয়ে চালিয়ে নিতে পারি। তাছাড়া অন্য কোনো সমস্যা হয় না।
তিনি আরো বলেন, তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। এখন দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিল দিয়ে টিকে থাকতে পারলে আলহামদুলিল্লাহ। তবে কখনো যদি সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই, তাহলে মোবাইল এক্সেসরিসের মালামাল তুলে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চাই।
সান্তাহার ডিজিটাল পোস্ট অফিসের কম্পিউটার ট্রেনার (অফিস অ্যাপ্লিকেশন) মিজানুর রহমান মিজান জানান, ৭০ জন ট্রেনিং নিতে আসে। তাদের মধ্যে দু’জন ছিল প্রতিবন্ধী। সজীব দু’চোখে দেখতে পারে না। তাদের জন্য ৫০ শতাংশ ছাড়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়। সজীবের রেজাল্ট ভালো ছিল। সজীব যান্ত্রিককণ্ঠ দিয়ে কম্পিউটার পরিচালনা করে থাকেন।
বিডি প্রতিদিন/এমআই