২২ মে, ২০২২ ২১:২৩

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে-পরকীয়ার কারণে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা!

নরসিংদী প্রতিনিধি

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে-পরকীয়ার কারণে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা!

নিহতদের বাড়িতে উৎসুক মানুষের ভিড়

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ও পরকীয়া সম্পর্কের কারণে নরসিংদীর বেলাবোতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। নিহতের স্বামীকে গ্রেফতারের পর তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার দায় স্বীকার করেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও ক্রিকেট ব্যাট জব্দ করা হয়। আজ রবিবার দুপুরে বেলাবো উপজেলার পাটুলি ইউনিয়নের বাবলা গ্রামের শেখবাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। 

এ ঘটনায় নিহতের স্বামী গিয়াস শেখ, প্রতিবেশী রেনু মিয়া, রিমন শেখ, রাজিবসহ কমপক্ষে ৫ জনকে আটক করেছে বেলাবো থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পি বি আই)। এঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। 

নিহতরা হলো গীয়াস উদ্দিনের স্ত্রী রহিমা বেগম (৩৫), তার ছেলে সন্তান রাব্বি (১৩) ও মেয়ে রাকিবা আক্তার (৬)। 

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পি বি আই) সূত্র জানিয়েছে, নিহত রহিমা বেগমের স্বামী গিয়াস শেখ পেশায় রং মিস্ত্রি। একইসঙ্গে মাদকাশক্ত ও জুয়াড়ি। আজ সকালে বেলাবোর পাটুলি ইউনিয়নের বাবলা গ্রামে একই পরিবারের ৩ জন নিহতের ঘটনায় নরসিংদী জেলা পুলিশ, ডিবি পুলিশ, বেলাবো থানা পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। সেখানে একটি ঘরের মেঝেতে স্ত্রী রহিমার রক্তাক্ত লাশ পড়ে ছিল। অন্য একটি ঘরে বিছানার ওপর দুই সন্তানের লাশ পড়ে ছিল। 

প্রথমে নিহতের স্বামী পুলিশকে জানান, কাজের সুবাদে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে বাড়িতে রেখে শনিবার সন্ধ্যায় গাজীপুরে যান তিনি। এরই মধ্যে সকালে মোবাইল ফোনে স্ত্রী ও সন্তানদের মৃত্যুর খবর পান। বাড়িতে এসে দেখেন একটি ঘরের মেঝেতে স্ত্রী রহিমার রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। অন্য একটি ঘরে বিছানার ওপর দুই সন্তানের লাশ পড়ে আছে। পরে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে নিহতের লাশ উদ্ধারের কাজ শুরু করেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, তিনটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার পর নিহতের স্বজনরা কান্নাকাটি শুরু করেন। কিন্তু নিহতের স্বামী গিয়াস শেখের আচরণ দেখে তার প্রতি সন্দেহ হয়। পরে তার মোবাইল ট্র্যাক করে এলাকায় থাকার তথ্য পায় পিবিআই। একইসঙ্গে পরকীয়ার বিষয়ে নিশ্চত হয় পিবিআই। পরে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে তিনি হত্যার কথা স্বীকার করেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাড়ির অদূরের একটি খাল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করা হয়। আরেকটি জঙ্গল থেকে রক্তমাখা ক্রিকেট ব্যাট উদ্ধার করা হয়।
  
পুলিশ সুপার মো. এনায়েত আরও বলেন, ঘাতক গিয়াস শেখের জবানবন্দী অনুযায়ী গিয়াস গাজীপুর চলে যাওয়ার কথা বললেও এটা সত্য নয়। সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেও গভীর রাতে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। তার স্ত্রী সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়লে রাত আড়াইটার দিকে গিয়াস ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে তার স্ত্রীকে উপর্যপুরি পিটান। পরে তাকে মাটিতে ফেলে মাথায় ও বুকের মাঝখানে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। স্ত্রীকে হত্যার পর পাশের ঘরে ঘুমন্ত ছেলে মেয়েকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।

তিনি বলেন, বাড়ির রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশী রেনু মিয়াদের সঙ্গে ঝগড়া ছিল। তাই মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এবং পরকীয়ার কারণেই ঠাণ্ডা মাথায় স্ত্রী সন্তানদের হত্যা করেন তিনি। শুধু তাই নয়, হত্যার পর আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও পিবিআইকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুপুর পর্যন্ত বিভ্রান্ত করে রাখেন।

এদিকে শরীফা আক্তার নামের এক প্রতিবেশী জানিয়েছেন, নিহত রহিমার কাছে জামা সেলাই করতে দিয়েছিলেন তিনি। সকাল ৭টার দিকে তিনি রহিমাদের বাড়ি আসেন। এসে ঘরের দরজা খোলা দেখতে পান। একইসঙ্গে রহিমাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। অনেক ডাকাডাকি করলেও কোনো সারা দেননি। কাছে গিয়ে রহিমার রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। পাশের ঘরে চৌকির ওপর দুই সন্তানের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। 

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পি বি আই) হাতে আটক হওয়ার আগে নিহত রহিমার স্বামী গিয়াস শেখ জানান, গত ১৫ দিন আগে বাড়ির পেছন থেকে একটি গাছ বিক্রি করেন তিনি। বাড়ির চারপাশে প্রতিবেশী রেনু মিয়ার জায়গা। এই গাছটি বাড়ির ওপর দিয়ে নিতে গেলে রেনু মিয়া বাধা দেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতিবেশী রেনু মিয়ার ঝগড়া হয়। ওই সময় রেনু মিয়া তাদের মেরে ফেলার হুমকি দেন। 
 
তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফরিদা বেগম জানান, গিয়াসের বাড়ির চারদিকের পুরো জায়গা রেনু মিয়ার। রেনুর জায়গা দিয়েই গিয়াসদের চলাচল করতে হয়। জমিজমা নিয়ে রেনুর সঙ্গে তার দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। কয়েক দিন আগে গিয়াস বিক্রির জন্য তার বাড়ির কিছু গাছ কাটেন। এই গাছ রেনুর জায়গা দিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে রেনু বাধা দেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। স্থানীয়রাও তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি জানতে পারেন।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবলা গ্রামে পাশাপাশি দুইটি মাটির ঘর। একটির মেঝেতে পড়ে আছে রহিমা বেগমের রক্তাক্ত লাশ। পাশের আরেকটি ঘরে পাশাপাশি দুইটি শিশু লাশ পড়ে আছে। বাড়ির আঙিনাজুড়ে শতশত উৎসুক জনতা। নরসিংদী জেলা পুলিশ, বেলাবো থানা পুলিশ সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। পাশেই নিহতের বড় ভাইয়ের স্ত্রী কান্নকাটি করছেন। ঘরের পেছনে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন নিহতের স্বামী গিয়াস শেখ।

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর