এ কে খন্দকারের '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' বইটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় গত ২ সেপ্টেম্বর। অনেকটা রবাহত হয়ে আমি সেই উৎসবে উপস্থিত ছিলাম। সঠিক সময়ের আগেই পৌঁছে দেখলাম বড় বড় যোদ্ধা ও লেখকরা সামনের সবকটি আসন দখল করে কিংবা সতীর্থদের জন্য সংরক্ষণ করে বসে আছেন। বেশ একটু পেছনে বসে আলোচনা শুনতে শুরু করলাম। স্বভাবতই এ আলোচনায় এ কে খন্দকার একজন বক্তা থাকবেন, কিন্তু তিনি যে প্রথম বক্তা হবেন তা অবশ্যই আশা করিনি। তিনি বক্তব্য রাখলেন এবং সব বিচারে তার বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত ছিল। তার বক্তব্যের অংশবিশেষ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা পরদিন তুলে ধরেছে।
বক্তৃতা শোনার আগেই আমি সুলভ মূল্যে বইটি কিনে নিয়েছিলাম এবং পড়তে শুরু করেছিলাম। পড়তে গিয়েই আমার চোখ এক জায়গায় থেমে গেল। এ কে খন্দকার লিখেছেন, "আমি এই বই লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছি মূলত তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়, অথচ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে। সত্য ও মিথ্যাকে তারা আলাদা করতে পারছে না। আমার এই বই তাদের জন্যে (পৃষ্ঠা-১১)।" অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্তি নিরসনের জন্যে মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর তার এই বই। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ২৮ মে ১৯৭১ সাল থেকে অংশ নিয়েছেন। ডেপুটি চিফ অব স্টাফের পদমর্যাদা লাভ করেছেন। এই ডেপুটি চিফ অব স্টাফের বঙ্গানুবাদ হচ্ছে উপ-প্রধান সেনাপতি। তাহলে ওসমানী ছিলেন চিফ অব স্টাফ। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। ওসমানীকে কেউ কেউ আজও সর্বাধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করে আনন্দ পান কিংবা নিজের অবস্থানকে উচ্চতর করেন। কিন্তু খন্দকার তার গ্রন্থে কর্নেল বা জেনারেল পদবিসহ ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি বলে সর্বত্র উল্লেখ করেন। তার পরের অবস্থানে রইলেন কর্নেল রব, যিনি একজন গণপ্রতিনিধিও ছিলেন। কর্নেল রবের সামরিক মর্যাদা খন্দকারের থেকে কম থাকলেও তাকে টপকে রব চিফ অব স্টাফের পদটি পেয়ে যান। খন্দকারের লেখায় মনে হয়েছে এ ব্যাপারে তিনি বরাবরই বিক্ষুব্ধ ছিলেন। মনে হয়েছে যে, কর্নেল রব ছিলেন ঢাকের বায়া আর পুরো যুদ্ধকালে অর্থাৎ ২৮ মে থেকে যুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত তিনি কর্নেল রবের সব কাজই করেছেন। সেই সুবাদে তিনি নিজকে উপ-প্রধান সেনাপতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং এ যাবৎ লেখালেখিতে তার নাম কখনো ডেপুটি চিফ অব স্টাফ বা কখনো উপ-প্রধান সেনাপতি হিসেবে দেখে এসেছি।
বইটিতে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, তিনি ১৯৪৭ সালে মেট্রিক পাস করে ওই সালে রাজশাহী সরকারি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। আমার খটকা লাগে এটা কেমন করে হয়, এইচএসসি বা এইচসি তো ১৯৬৩ সালে প্রচলিত হয়, যে সালে তিনি ৩৪ বছর বয়সে উইং কমান্ডার সাইফুর মীর্জার ছোট বোন ফরিদা মীর্জার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পাকিস্তানে চাকরি করেন এবং পাকিস্তানে অবস্থানকালে পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেয়েছেন (পৃষ্ঠা ২০)। মুক্তিযুদ্ধে উপ-প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করলে পাকিস্তানিরা তার ভাইদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে তার খোঁজখবর নিলেও তাদের কোনো ক্ষতি বা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেনি, এমনকি তাকে কাজে দ্রুত পুনঃ যোগদানের তাগিদ দিয়ে তাদের ভাইদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন (পৃষ্ঠা-২১৩)। সেদিক দিয়ে তিনি সৌভাগ্যবান, কেননা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জানমাল, সহায় সম্বল, ইজ্জত সম্ভ্রমের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল।
খন্দকার ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এলেও ওই সময় গণঅভ্যুত্থান বা বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা তার ছিল না। এমনকি ছাত্রাবস্থায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষলগ্ন ও সুতিকাগার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তার ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। পাকিস্তান আমলে তিনি ও তাওয়াব পূর্ব পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ বৈমানিক ছিলেন। এই তাওয়াবই বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর চাঁদতারা মার্কা পতাকা চেয়েছিলেন যদিও তার পত্নী ছিলেন জার্মান। খন্দকার ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান ভারতের যুদ্ধে সার্বক্ষণিক ককফিটে অবস্থান করেন, বীরত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে কোনো অপারেশনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অংশ নেননি। তার মূল দায়িত্বটা ছিল প্রশাসনিক, পরামর্শমূলক, সংযোগ সমন্বয়কারী ও প্রশিক্ষণদাতার। এমন দায়িত্ব আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর হয়ে পালন করি। প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিয়ে ৭ এপ্রিল থেকেই আগে গঠিত বিএলএফ বা শ্রদ্ধাভরে নামাঙ্কিত মুজিব বাহিনীর পুনর্গঠন শুরুর কাজে আত্দনিয়োগ করি। খন্দকার মুজিব বাহিনীর নামকরণে জেনারেল এস এস ওবানের ভূমিকা দেখেছেন। এবারে মূল প্রসঙ্গের অবতারণা করছি যদিও খন্দকারের প্রদত্ত বক্তব্যের অংশবিশেষ পত্রিকায় এসেছে। সহৃদয় পাঠক তা দেখে নিতে পারেন (৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোসহ আরও কিছু পত্রিকা)।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন- 'সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা এখনো চলছে'। বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকৃত ঘটনা লেখার চেষ্টা তিনি করেছেন। তিনি বলেন, 'যে জাতি সত্যকে লালন করতে পারে না, প্রকৃত ইতিহাসকে যারা বিকৃত করে সেখানে সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না' (প্রথম আলো, ৩ সেপ্টেম্বর)। তাই তিনি সত্য প্রকাশে অনড় থাকার পরামর্শ দেন এবং কোনো রকম ভণ্ডামি, অতিরঞ্জনকরণ বা প্রকৃত ঘটনার বিকৃতি কখনো ক্ষমার যোগ্য হবে না বলেও উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যে তুমুল করতালির সঙ্গে আমিও হাত সংযোজিত করি। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরে ডাক্তার সারোয়ার আলীর বক্তব্যে আমার সত্য নিয়ে খটকা বাধে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ খন্দকার সাহেব ক্যান্টনমেন্টে বসে শুনেছেন। তিনি লিখেছেন, '৭ মার্চের ভাষণের দিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক ছিল, সবাই ব্যস্ত ছিল নিজ নিজ কাজে (পৃষ্ঠা-৩১)। লক্ষণীয় যে, এই নিজ নিজ কাজে ব্যস্তদের নিয়ে তিনি অতর্কিত হামলা করে বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যাশী ছিলেন। তিনি ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল 'জয় পাকিস্তান।' সত্যি কথা কি সেখানে দুটো শব্দ ছিল। তিনি যদি একই সঙ্গে জয় বাংলা ও জয় পাকিস্তান শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করতেন তাহলে তার পেশাজীবীর সততা, সৈনিকের সততা, যোদ্ধার সততা ও একজন নির্মোহ রাজনৈতিক ব্যক্তির সততা কিছুটা হলেও প্রকাশ পেত, কারণ তার দুজন সহযোগী আগে এমন কথা বলেছেন। তবে মনে হয় তার আসল মতলব ছিল ওইসব মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য খণ্ডন যারা ৭ মার্চের ভাষণই প্রকারান্তরে স্বাধীনতার আহ্বান ছিল বলে নিশ্চিত। আসলে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যে বক্তব্য 'জয় বাংলা' দিয়ে শেষ হয়, তাতে কি স্বাধীনতার আহ্বান না পাকিস্তান রক্ষার অভিপ্রায় ব্যক্ত থাকে? যারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জয় বাংলা ও জয় পাকিস্তান শুনেছেন তারা হলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও শাজাহান সিরাজ। এ দুজন ছাড়া ১০ লাখের শ্রোতার কেউই এমন শব্দগুচ্ছ শুনেনি; তারা শুধু জয় বাংলা শুনেছে। শাজাহান সিরাজ রেসকোর্সে উপস্থিত হয়ে শুনলেন যে, বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা-জয় পাকিস্তান বলে তার ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন। তার এমন উচ্চারণের প্রয়োজন ছিল। কেননা সেটা তার মন্ত্রী হওয়ার কাজে লেগেছে।
এ সমালোচনা আমার ছিল, কেউ পড়েছেন কিনা জানি না। হাবিবুর রহমানের বক্তব্যের সমালোচনাও আমিসহ অনেকে করেছেন। এ কথার প্রতিধ্বনি সারোয়ার আলীর বক্তব্যে অর্থাৎ খন্দকারের বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে শুনেছি। সারোয়ার আলী যুক্তি ও দালিলিক প্রমাণ দিয়ে বলতে চেয়েছেন খন্দকারের এ বক্তব্যটি বিতর্কের সূচনা করবে। একই কথা দু'একজন আলোচক অতি দুর্বলভাবে উত্থাপন করার প্রয়াস যে পাননি তা নয়। সামনের সারিতে উপবিষ্ট একজন শ্রোতা এ ব্যাপারে কিছু বলতে গিয়ে বসে যেতে বাধ্য হন এবং আসন ছেড়ে চলে যান। আমরা কয়েকজনও ওসমানীর নামের সঙ্গে 'সর্বাধিনায়ক' শব্দটি উচ্চারিত হলে মৃদু প্রতিবাদ করি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত থেকে ৭ মার্চে যা শুনেছিলাম তা বলতে সুযোগ খুঁজেছিলাম।
তারপরের আলোচক ছিলেন অধ্যাপক আলী রিয়াজ। তার বক্তব্য পরদিনের প্রথম আলোতে নিবন্ধ আকারে এসেছে এবং বিদগ্ধ পাঠক হয়তো তা পড়েছেন। তবে তাদের কারও বক্তব্যে খন্দকার উত্থাপিত প্রসঙ্গগুলো সঠিকভাবে আলোচিত হয়নি। তার উত্থাপিত প্রসঙ্গগুলো ছিল বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার কথা বলেননি, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা বা অর্জনের কোনো লক্ষ্য, কৌশল বা কর্মসূচি গ্রহণ করেননি; তিনি ২৬ মার্চ কস্মিনকালেও স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, যুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া অন্যরা ছিলেন নিষ্কর্মা, কলহে বা বিলাস ব্যসনে ব্যস্ত; যুদ্ধের ব্যাপারে অনিবেদিত ও অজ্ঞাত, ভারতীয়দের অনীহা বা দোদুল্যমানতা, যোদ্ধা সংগ্রহে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য, মুজিব বাহিনীর দৌরাত্দ্য, তাকে টপকিয়ে জেনারেল রবকে চিফ অব স্টাফ নিয়োগ বা তাকে সমর কাউন্সিলের প্রধানের পদ না দেওয়া। প্রসঙ্গত, তিনি চিফ অব স্টাফের দায়দায়িত্ব বর্ণনা করেন এবং যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেই সম্ভবত তিনি উপ-প্রধান সেনাপতি অভিধা গ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথি হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যের অনুরণ আমার কানে আগেও বেজেছে। তিনি শারমিন আহমদ প্রণীত 'তাজউদ্দীন : নেতা ও পিতা (২০১৪)' গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে যা বলেছেন তার কিছুটা পুনরাবৃত্তি এখানে ঘটেছে। তবে শারমিনের বইয়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি পিতার স্বকণ্ঠ কথা বা বক্তব্যের চেয়ে চাচাদের ওপর বড্ড নির্ভর করেছেন। রাত ৯টায় তাজউদ্দীন আহমদ চলে আসার পরও স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে কিংবা বিভিন্ন মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে তার উল্লেখও শারমিনের বইতে আছে। ৭ মার্চের ভাষণ বা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে পরিমিত আলোচনাসহ প্রফেসর আনিসুজ্জামান মুজিব বাহিনীর প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন। এসব আগেও তিনি উদ্ধৃত আকারে মইদুল হাসান বা অন্যদের বই থেকে তুলে ধরেছেন। তবে তিনি একটি নতুন তথ্যের অবতারণা করেছেন যার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, "১৯৭১ এর অক্টোবর মাসে আগরতলা গিয়ে তিনি একটি লিফলেট হাতে পান। মুজিব বাহিনীর নামে প্রচারিত এই লিফলেট পাকিস্তানকে এক নম্বর, বামপন্থিদের দুই নম্বর ও তাজউদ্দীন সরকারকে তিন নম্বর শত্রু উল্লেখ করে সবাইকে উৎখাতের আহ্বান ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। মুজিব বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারক হিসেবে অতি কাছে এই আগরতলায় থেকেও আমি এ ব্যাপারে অবগত ছিলাম না; যদিও বামপন্থিদের সঙ্গে দু'একটি সংঘাত ও সংঘর্ষ এবং তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজনের মন কষাকষির কথা আমার জানা ছিল। এসব প্রসঙ্গে আমি 'মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী' গ্রন্থে কিংবা 'এক দেহ দুই প্রাণ' (২০০৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেছি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অনেকেই অনেকভাবে দিয়েছেন, আমিও দিয়েছি। ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি আলোচনা ও পরে টেলিফোনিক আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধে দেশ স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত আমার এবং শেখ ফজলুল হক মণির কাছে ব্যক্ত করেন। ভারতে যে তিনি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আগেই রেখেছিলেন তাও আমাদের জানালেন। খন্দকার সাহেবও এমন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল বলে মেনে নিয়েছেন। তাজউদ্দীন সাহেব যে তথ্য-বিভ্রান্তির কারণে চিত্ত সুতারের সঙ্গে প্রথমবার দেখা করতে না পারলেও দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবন্ধু মনোনীত সেই চিত্ত সুতারের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর নেতাদের নিয়ে একত্রে বসেছিলেন সে কথা অনেক গ্রন্থে আছে। আমি এই তথ্য বহু লেখায় ও বক্তব্যে উপস্থাপন করেছি। বঙ্গবন্ধু ট্রেনিং, অর্থায়ন ও সার্বিক ব্যবস্থার জন্য চিত্ত সুতারের কথা উল্লেখ করে ইতিমধ্যে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুর কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ৩ মার্চ পূর্বাহ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সভা মোজাফফর চৌধুরীকে দিয়ে আহ্বান করিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমি স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক সমর্থন করলে তারস্বরে আমি তা ঘোষণা করি। এ দুজন শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে অবসর নিয়েছেন এবং বর্তমানে বেঁচে আছেন। তাদের নাম দুর্গাদাস ভট্টাচার্য ও শহীদ উদ্দিন আহমদ। আর একটি প্রশ্ন; তাজউদ্দীন সাহেব কোন ভিত্তিতে দিলি্ল যাওয়ার আগেই চিত্ত সুতারের বাড়ি খুঁজতে গিয়েছিলেন। কোনো আলোচনা না হলে বা সিদ্ধান্ত না থাকলে তিনি তাকে খুঁজতে যাবেন কেন? চিত্ত সুতার নাম বদলিয়ে ভারতে অবস্থান করছিলেন বলে তিনি প্রতিবেশীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে প্রথম দফায় তার খোঁজ পাননি। আগেই বলেছি পরবর্তীতে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে চিত্ত সুতারসহ মুজিব বাহিনীর নেতাদের সাক্ষাৎ পান। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাক্তার আবু হেনাও পূর্বাহ্নে এই ট্রেনিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই ট্রেনিং প্রাপ্তির ব্যবস্থা যে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি ছাড়াই রেখেছিলেন তা কোনো অবস্থায়ই মনে করার সঙ্গত কারণ নেই।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বইটির লেখক হিসেবে মইদুল ইসলামকে চিহ্নিত করেছিলেন। আমরা তার ভুলটির ইঙ্গিত করলে তিনি তা সংশোধন করেন। তবে তিনি যে মইদুল হাসান দ্বারা আক্রান্ত ও আপ্লুত তা বোঝা গেল। তিনি আরও লিখবেন বলে জানান দিয়ে গেছেন। তার লেখার অপেক্ষায় রইলাম। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং আমি তার অধীনে কিছু দিন সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করি। যুদ্ধকালে তিনি কোনো ভূমিকা পালন করেছেন বলে আমার জানা নেই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।