জুলাই সনদ নিয়ে ঐক্যের আবহে অনৈক্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ঐকমত্য কমিশন তাদের প্রস্তুত করা প্রস্তাব সব রাজনৈতিক দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে এমন অভিযোগও ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের অর্ধশতাধিক বৈঠক শেষ পর্যন্ত অশ্বডিম্ব প্রসব করতে পারে এমন আশঙ্কাও জোরদার হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা সচল থাকলেও তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ ক্রমান্বয়ে কমছে। শুরুতে নির্ধারিত সময়ে সবাই সংলাপে অংশ নিলেও এখন কেউ আসছেন দেরিতে, আবার কেউ হাজিরা দিয়েই ছুটছেন বাইরে। ৩০টি রাজনৈতিক দল এ কমিশনের সংলাপে অংশ নিলেও মূলত তিন থেকে চারটি দলের মতের ওপরই আলোকপাত হচ্ছে। বলতে গেলে প্রায় সবাই তাকিয়ে রয়েছেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ঐকমত্যের ওপর। কিন্তু মূল কয়েকটি ইস্যুতে তাদের মতপার্থক্য আকাশপাতাল।
শেষ কয়েকটি বৈঠকে ‘চাপ’ আর ‘বাধ্য’ এ দুটি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ‘জুলাই সনদ’-এর অপেক্ষা না করে আগামী ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। দলটির আহ্বায়ক বলেছেন, অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতা করেছে। এ ঘোষণাপত্র ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশের মানুষের আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রণয়ন ও ঘোষণা করা হবে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ অব্যাহত থাকলেও কোনো অগ্রগতি না থাকায় সব পক্ষই কম বেশি হতাশ। ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বে যে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় যুক্ত হয়েছে, সেখানেও সাফল্য আহামরি কিছু নয়। লাগাতার আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়েছে মাত্র দুটি বিষয়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ঐক্যের বদলে মতদ্বৈততার চিত্রই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বোদ্ধাজনদের মতে, মতদ্বৈধতা এড়াতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে ওই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সেটিই হবে উত্তম।
কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে যে অপরিসীম অনাচার হয়েছে সে ক্ষয়ক্ষতির উপশম, তথা বিদ্যমান অব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে গত আগস্টে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর সংস্কার কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে সেই কমিশনগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনে স্বৈরাচারী সরকারের নিষ্ঠুরতায় রাজপথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত ছাত্র ও সর্বস্তরের সাধারণ নাগরিকের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান নারী-শিশুসহ দেড় হাজার মানুষ। আহত হন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। যাদের অনেকেই চোখ-হাত-পা হারিয়ে স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন। স্বৈরাচারের পতনের পর বিজয়ী ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কারের জোর আওয়াজ তোলে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও স্বৈরাচারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান মেরামতের দাবি তোলে উচ্চ কণ্ঠে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জুলাই-অভ্যুত্থানের মূল বাণীকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে জুলাই ঘোষণাপত্র সংবিধানে সংযোজনের দাবি জানিয়ে আসছে প্রথম থেকেই।
এখানে একটা ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। অনেকে জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন। একাত্তরের অর্জন কিছুই নয়, এমন কথাও বলেন। এই বিচ্যুতি প্রকারান্তরে জুলাই গণ অভ্যুত্থানকে নিষ্প্রভ করে তুলবে। কোনো জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলতে পারে না। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনে জনগণের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ভোটের অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। জনগণের স্বাধীনতা না থাকলে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা স্বকীয়তা হারায়। যে কারণে নির্যাতন-নিপীড়নের মুখেও ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে দেশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল। লাল সবুজ পতাকা আর মুক্তিযুদ্ধের হার না মানা সাহস তাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
জুলাই সনদেও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে হবে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে একাত্তরের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে। এর বাইরে থাকতে হবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার বিশাল গণসংগ্রাম। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা স্বাধিকার-স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রাজপথের লড়াই বা ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের কথাও থাকতে হবে জুলাই সনদে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী শাসনবিরোধী গণ আন্দোলনের বিষয়টিও অবশ্যই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরেক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যাবে না। স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের বিশাল আত্মত্যাগের সব উপখ্যান জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে জুলাই সনদের মাধ্যমে।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাতির হাজার বছরের সেরা অর্জন। তবে গণতান্ত্রিক অধিকারবঞ্চিত জনগণের বৈপ্লবিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে জুলাই গণ অভ্যুত্থানেরও কোনো তুলনা চলে না। কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ নেত্রী ও স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের অগণতান্ত্রিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে গণ মানুষের লড়াই আমাদের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের রাজপথের লড়াই আত্মত্যাগের যে ইতিহাস রচনা করেছে, তার কোনো তুলনা নেই। তাই এটাকে জুলাই সনদ হিসেবে সংবিধানে সংযোজনের দাবি শতভাগ যৌক্তিক। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে যে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, তার সামান্যতম অবমূল্যায়ন করা চলবে না। আত্মঘাতী এ প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের ঐক্যে বিভাজন সৃষ্টি করবে; যা কাম্য নয়।
ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দিনের পর দিন বৈঠক করে চালাচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই ঘোষণাপত্র প্রস্তুতের কাজ। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সংস্কার কর্মকাণ্ড দ্রুত এগুনোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সঙ্গে থেকে সর্বোচ্চ সাধনা করে যাচ্ছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ইতিমধ্যে এক বিশাল অর্জন হয়েছে। সংবিধানের যে ৭০ অনুচ্ছেদ জবাবদিহিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠায় পাহাড়সম বাধা হয়ে বসেছিল, তা পরিবর্তনে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। তা হচ্ছে অর্থবিল, সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব ও যুদ্ধাবস্থা ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে ও ভোট দিতে পারবেন। স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর পরে এ অর্জনে বুদ্ধিজীবী মহল ও গণতন্ত্রকামী সচেতন দেশবাসী সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তবে তারা সবাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নে যত্নবান হবেন এমনটিও আশা করছেন।
এখনো ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যায়, জুলাই সনদ প্রণয়ন ও রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে আরও বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেবেন। তবে সবকিছু ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় অর্জিত হবে, এমনটি ভাবা সঠিক হবে না। দেশের ইতিবাচক রাজনীতি ও সুশাসন এবং সর্বক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, আগামী নির্বাচনে যারাই জয়ী হবেন, তারা জুলাই গণ অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতে হবে সব দলকেই। গণতন্ত্রের বদলে কেউ কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের চেষ্টা করলে তাদের পরিণাম যে ভালো হবে না, তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক