বিজ্ঞাপনের ইতিহাস মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার মতোই দীর্ঘ ও বিচিত্র। সভ্যতার প্রথম দিকেই মানুষ পণ্য ও সেবার প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। প্রাচীন মিসরীয়রা প্যাপিরাসে হাতে লেখা বিজ্ঞপ্তি টাঙাত, প্রাচীন গ্রিসে বাজারে হেরাল্ডরা (ঘোষক) পণ্যের প্রশংসা করত উচ্চৈঃস্বরে, আর প্রাচীন রোমে দেয়াললিখন ও পোস্টার হয়ে উঠেছিল ব্যবসার পরিচিত কৌশল। কিন্তু আধুনিক অর্থে বিজ্ঞাপনের প্রথম রূপটি গড়ে ওঠে সংবাদপত্রের হাত ধরে। বিশ্বের প্রথম মুদ্রিত বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল ১৪৭২ সালে ইংল্যান্ডে লন্ডনের একটি চার্চের দরজায় টাঙানো প্রার্থনার বইয়ের বিজ্ঞপ্তি ছিল সেটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠল জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর অন্যতম কার্যকর মাধ্যম।
২০ শতকের শুরুতে প্রযুক্তির অগ্রগতি বিজ্ঞাপনকে নতুন দিগন্তে নিয়ে গেল। রেডিওর আবিষ্কার বিজ্ঞাপনের জগতে বিপ্লব ঘটাল। ১৯২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বাণিজ্যিক রেডিও বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, যা দ্রুত বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুরেলা কণ্ঠ, সংলাপ এবং সংগীত মিশিয়ে যে নতুন ধরনের আকর্ষণ তৈরি হলো, তা শ্রোতার মনে সরাসরি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। এরপর এলো টেলিভিশন, যেখানে শব্দ ও দৃশ্য মিলিয়ে বিজ্ঞাপন হয়ে উঠল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। ১৯৪১ সালে নিউইয়র্কে প্রথম টিভি বিজ্ঞাপন সম্প্রচারিত হয়, বুলোভা ঘড়ির একটি ছোট্ট বিজ্ঞাপন। সেই মুহূর্ত থেকে বিজ্ঞাপন শুধু তথ্য পরিবেশনের মাধ্যম নয়, বরং সংস্কৃতি, বিনোদন ও ভোক্তার চালিকাশক্তি হয়ে উঠল। হু হু করে বাড়ল পণ্যের চাহিদা। ২০০৩ সালে হোন্ডার তৈরি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন ‘Cog’ মাত্র ৩২ হাজার পাউন্ড খরচ করে বানানো হয়েছিল, কিন্তু এই বিজ্ঞাপন নির্মাণের ফলে হোন্ডার গাড়ি বিক্রিতে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় হয়- যা বিজ্ঞাপন ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এক বিরল রেকর্ড।
ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে কলকাতায় বিজ্ঞাপনের প্রভাবও ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। বাংলার একমাত্র নোবেলজয়ী সাহিত্যিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরাসরি বিজ্ঞাপন নির্মাতা ছিলেন না, তবে ঠাকুর পরিবারের ব্যবসায়িক পণ্যের প্রচারে তিনি ছোট ছোট কবিতা ও ছড়া লিখেছিলেন, যা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হিসেবে ছাপা হতো। এতে তাঁর সাহিত্যিক ভাষা বিজ্ঞাপনের অংশ হয়ে উঠেছিল। যদিও তিনি কখনোই বিজ্ঞাপনকে পেশা হিসেবে বেছে নেননি। অন্যদিকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পেশাগতভাবে বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ শুরু করেন এবং গ্রাফিক ডিজাইন, ইলাস্ট্রেশন থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন ফিল্ম নির্মাণ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। বিজ্ঞাপনের অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণে শিল্পনৈপুণ্য ও ভিজ্যুয়াল কল্পনাকে সমৃদ্ধ করে।
বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের ইতিহাসও বিশ্ব প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিশে এক অনন্য ধারা তৈরি করেছে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনই ছিল মূল ভরসা, আর তখনকার বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোও ছিল সীমিত পরিসরে। কিন্তু স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রে ব্যবসায়িক প্রচারের নতুন কাঠামো তৈরি হতে থাকে। আশির দশকের দিকে এসে বিজ্ঞাপনের জগতে আধুনিকতার ছোঁয়া আনে কিছু মেধাবী মানুষ, যারা শুধু ব্যবসা নয়, শিল্প ও সৃজনশীলতার মিশ্রণে বিজ্ঞাপনকে নতুন মর্যাদায় নিয়ে যায়। এই পরিবর্তনের অগ্রনায়ক ছিল ‘মাত্রা অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড’-এর কর্ণধার বিশিষ্ট অভিনেতা আফজাল হোসেন ও সানাউল আরেফীন। আফজালের সঙ্গে আমার পরিচয় টেলিভিশন সূত্রে। আমি তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘শিল্পায়নে বাংলাদেশ’ নামে একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে পড়ছি। পাশাপাশি সাগর আর আমি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ওদের ‘খাবার-দাবার’ নামে রেস্তোরাঁ চালাই। দারুণ ব্যস্ততা আমাদের। সাগর যখন টেলিভিশনে আমি তখন রেস্তোরাঁয় বসি, আবার আমি হয়তো ক্লাসে কিংবা টিভিতে, সাগর তখন খাবার-দাবারে বসছে। কিন্তু বিকালে সবাই খাবার-দাবারে আড্ডায় বসতাম। আমাদের বন্ধু ইমদাদুল হক মিলন, আবদুর রহমান, মুহাম্মদ জুবায়ের, দিদারুল আলম প্রমুখ মিলে জম্পেস আড্ডা হতো। অনেকটা কফি হাউসের মতোই। খাবার দাবার-এ শুধু আমরা নই। আরও অনেকে এসে আড্ডা দিতেন। বিশেষ করে এটি হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক জগতের মানুষের একটা প্রিয় আড্ডাখানা। সে সময় এই খাবার-দাবারে বসেই টেলিভিশনের অনেক অনুষ্ঠান পরিকল্পনা হয়েছে। আমাদের ছোট্ট কাচঘেরা ঘরটিতে বসে কত নাটকের স্ক্রিপ্ট রচিত হয়েছে! আফজালও আসত খাবার-দাবারে।
সেখান থেকেই আফজালের সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরু। আফজাল, আরেফীন আমার আর সাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাত্রার অফিস ছিল পল্টনে আর আমাদের টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ক্যাটসী-এর অফিসও ওদের অফিসের খুব কাছে ছিল। নিয়মিত আসাযাওয়া ছিল আমাদের। আর চলত ধুমসে আড্ডা। আফজালের ভিতর খেয়াল করতাম একটা ক্যারিশমা আছে, যা একদমই অন্যরকম। মিশতে গিয়ে দেখলাম তার আদ্যোপান্ত আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আফজাল একবার একটি নাটক বানাল। সেখানে আমাকেও কাস্ট করেছিল। নাটকের নাম, সেতুকাহিনি। বিষয় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা। আমার চরিত্র ছিল ওই সংস্থার একজন অফিসার আর আমার বস হিসেবে অভিনয় করেছিল আমাদের আরেক বন্ধু তুমুল জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী হুমায়ুন ফরীদি। আফজালকে নিয়ে আমার স্মৃতির কোনো শেষ নেই। একবার বিজ্ঞাপনের সেটে সবকিছু রেডি, সব শিল্পী রেডি সকাল থেকে। অথচ আফজাল নিরুদ্দেশ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাচ্ছে কিন্তু সে কোনোভাবেই হাজির হচ্ছে না। সবার ভিতরই চাপা বিরক্তি। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে আফজাল খুবই ধীরেসুস্থে সেটে এলো। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, সেটের জন্য প্রয়োজনীয় প্রপস কিনতে সে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা দিন। একদম নিখুঁত না হলে সে কোনো কাজেই হাত দিত না। তাই তার আরেকটা নাম ছিল পারফেকশনিস্ট। আর নিজে সন্তুষ্ট না হওয়া অবধি সে কাজ শুরুই করত না। আমার মনে পড়ে আফজালের একটি কাজে আমি ভিএইচএস ক্যামেরা ওয়ার্কিং করেছিলাম।
বলা চলে মাত্রা অ্যাডভার্টাইজিংয়ের হাত ধরেই বাংলাদেশে আধুনিক বিজ্ঞাপনের সূচনা ঘটে। আফজাল হোসেন ও তার অংশীদার এবং সহকর্মীরা বুঝেছিল, একটি বিজ্ঞাপন কেবল পণ্য বিক্রির মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি গল্প বলবার প্রচেষ্টা, একটি অনুভূতি, মনের ওপর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তৈরি করার উপযুক্ত কৌশল। তারা বিজ্ঞাপনকে কেবল ব্যবসার বাজারের পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পৌঁছে দিয়েছিল তা শিল্পের মতো করে। সেই সময়ের বিজ্ঞাপনগুলোতে নতুনত্ব ছিল ভাষা, ভঙ্গি ও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায়। নাটক, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যের মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই ধারায় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠে মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি। আরও মনে পড়ে আমিন জুয়েলার্স, এইডস নিয়ে সচেতনতামূলক টেলিভিশনের জন্য নির্মিত গান, ‘শোনো মানুষ’-এর কথা, যেখানে বাংলাদেশের তৎকালীন সব তারকা গানটিতে অংশ নিয়েছিলেন। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল সেই গানটিতে অংশ নেওয়ার। আজও মনে পড়ে অলিম্পিক ব্যাটারির মতো দুর্দান্ত সেই বিজ্ঞাপনটির কথা। জিঙ্গেল করেছিলেন প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চু আর মডেল ছিলেন প্রয়াত মিতা নূর। আফজাল, আরেফীনদের হাত ধরেই আসতে থাকল একের পর এক চমক। আফজালের নির্মাণে বিখ্যাত আরও বিজ্ঞাপনগুলোর ভিতর ছিল, ইস্টার্ন ফেব্রিকস, পাকিজা, জুঁই নারিকেল তেল, পিয়ারসনস, ম্যানোলা, ডানকান টি এবং এরকম আরও অসংখ্য ভালো বিজ্ঞাপন। এশিয়াটিক-ও অসাধারণ সব কাজ নিয়ে হাজির হলো। আরও যেসব বিজ্ঞাপনী সংস্থা তখন দারুণ কাজ করছিল, তাদের মধ্যে এশিয়াটিক, ইন্টারস্পিড, এক্সপ্রেশনস, ইউনিট্রেন্ডের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে সময় টেলিভিশনে বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হলো বিজ্ঞাপন। মানে সবাই মিলে বিজ্ঞাপন দেখাও যেন একটি অনুষ্ঠান দেখার মতো অনুভূতির সঞ্চার করল। আর এখন মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে মোবাইল ফোনে। আর তখন একটা বিজ্ঞাপন না দেখা মানেই সব মিস। সময় কত দ্রুত বদলে যায় ভাবতেই অবাক লাগে।
আফজাল হোসেনের অবদান কেবল তার পেশাদারত্বে সীমাবদ্ধ নয়। সে তার চারপাশের মানুষদের সৃজনশীলতার যাত্রায় যুক্ত করেছিল। আফজাল হোসেন বিজ্ঞাপনের ক্যানভাসে মানুষের মনে আস্থা ও আবেগের বীজ বপন করছিল। এক ধরনের অনুপ্রেরণা ছিল তার কাজগুলো, যেখানে মিডিয়া, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞাপন মিলেমিশে তৈরি করেছিল বাংলাদেশের আধুনিক বিজ্ঞাপনের ভিত। তার হাতেই বিজ্ঞাপনজগতে পা রেখেছেন পল্লব, নোবেল, তানিয়া, সুইটি, ফয়সালসহ আরও অনেকে।
বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল মানে একটি পারফেক্ট লাইফস্টাইল। ঢাকার চারুকলার পুরোটাই যেন তার ভিতর বাস করত। আফজাল শুধু একজন নির্মাতা ছিল না। একাধারে, সেট, মেকআপ, প্রপস, লাইট, কস্টিউম, লোকেশন ঠিক করা, শিল্পী নির্বাচন করা এবং স্ক্রিপ্ট লেখা ও ভয়েসওভার আর্টিস্ট হিসেবে ছিল অনবদ্য একজন মানুষ। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনজগতের এক কিংবদন্তি। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের ইতিহাস কেবল একটি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার ইতিহাস বা বিবরণ নয়। এটি এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক যাত্রা, যেখানে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম শিখেছে কীভাবে শিল্প, ভাষা এবং বাণিজ্যকে একসূত্রে গেঁথে মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলা যায়। আফজাল হোসেন, সানাউল আরেফীন এবং তাদের সমসাময়িকরা যখন এই দেশে বিজ্ঞাপনের শৈল্পিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করছিল, তখন মানুষের হৃদয়ে তারা এক অমোঘ ছাপ রেখে গেছে। আজ মাত্রা অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড ৪০ বছরের পথে পা রাখল। তাদের প্রতি শুভকামনা জানাতে আমার কাছে যে ভাষা আছে, তা মোটেই যথেষ্ট নয়। শুধু এটুকুই বলতে পারি, বিজ্ঞাপন মানুষের মন ও অনুভূতিতে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে, আর সেই যাত্রার পথপ্রদর্শক হিসেবে সবার আগে যে নামটি মাথায় বারবার ফিরে আসে, সেটি হলো মাত্রা অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব