প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই নির্বাচন হবে বলে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট কোনোভাবেই কাটছে না। রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা বৈঠক
করেছে। আরেক দফা বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। কোনো অবস্থায়ই জুলাই জাতীয় সনদ ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বলতে গেলে জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার প্রভাবে দলগুলোর মধ্যে বিভাজন দিনদিন স্পষ্ট হচ্ছে। কিছু দল নির্বাচনের পক্ষে, আবার কিছু দল নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় ধাপে হতে যাওয়া সংলাপে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। দুই দফায় হওয়া অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নেওয়া হচ্ছে। ওইসব মতামত নিয়ে কমিশন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করবে। এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিতে চায় সরকারের ওপর। কমিশন বলছে, ‘আমাদের দায়িত্ব জুলাই সনদ তৈরি করা। বাস্তবায়ন করবে সরকার।’ কিন্তু সনদ তৈরিতেও রয়েছে নানান গলদ। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য মৌলিক ইস্যুতে একমত হতে পারেনি দলগুলো। কিছু বিষয়ে একমত হলেও সঙ্গে যোগ হয়েছে নোট অব ডিসেন্ট। অন্যদিকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায় আলোচনায় অংশ নেওয়া দুটি দল জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাদের সঙ্গে একই দাবিতে যোগ দিয়েছে সমমনা জোটগুলো। অন্যদিকে আইনি ভিত্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। তাদের সঙ্গেও রয়েছে সমমনা কয়েকটি দল। বিষয়টি নিয়ে কমিশন দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করলেও সুরাহা হয়নি। বরং সংকট আরও বেড়েছে। দলগুলোর নেতারা তাই এখনই জুলাই সনদ আলোচনাকে ব্যর্থ বলে দাবি করছেন। তাঁদের বক্তব্য, এত বৈঠকের পরও আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তবে সেগুলো রাষ্ট্র সংস্কারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।
এদিকে টানা দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার পর বাম জোটগুলো দাবি করছে, জুলাই জাতীয় সনদে তারা স্বাক্ষর করবে কি করবে না, সে সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। তাদের দাবি, শেষ দিকের বৈঠকে রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে আলোচনায় তারা বৈঠক বয়কট করেছে। কারণ কমিশন তাদের এখনো স্পষ্ট করেনি জুলাই জাতীয় সনদে রাষ্ট্রের বিদ্যমান সংবিধানে থাকা চার মূলনীতি থাকবে কি থাকবে না। যদি না থাকে তাহলে এতে স্বাক্ষর করার প্রশ্নই ওঠে না। সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। সেখানে খসড়া সনদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে যতদূর সম্ভব লিখিত মতামতগুলোর প্রতিফলন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। একই সঙ্গে সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে মতামত জানানোর জন্য বলা হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, আপনাদের মতামত পেলে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারকে বিস্তারিত জানানো হবে। সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা বলেছি যেভাবে আলোচনা হয়েছে, সেভাবে বিষয়গুলো না রাখলে অনেকেই হয়তো সনদে স্বাক্ষর করবে না।’
এদিকে আগামী সপ্তাহ থেকে তৃতীয় দফার আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে ওই আলোচনায় খুব বেশি আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি দলের নেতারা। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তাঁরা বলেন, অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া সম্ভব হয়নি। কেউ ছাড়ও দিতে রাজি নয়। কমিশনের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে বৈঠক করতে গিয়ে দলগুলোর মধ্যে বরং বিভেদ আরও বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আদর্শগত সংকট দেখা দিয়েছে। আবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কমিশন দলগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করলেও চূড়ান্ত খসড়া জাতীয় জুলাই সনদে সিদ্ধান্ত হিসেবে জানিয়েছে। এটাকে কমিশনের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়া বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। ছয়টি সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪ বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জাতীয় জুলাই সনদ। জুলাই মাসে এ সনদ চূড়ান্ত করার লক্ষ্য থাকলেও তা পূরণ হয়নি। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতার কারণে এটি আটকে আছে। দলগুলোর মতে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে সব দলের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করেছে, তার আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করা না হলে এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব না হলে পরবর্তীতে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তারা যে এ সনদ বাস্তবায়ন করবে তার নিশ্চয়তা কী? এজন্য জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেই এর ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদের মতো দলগুলো নিজেদের এমন অবস্থানের কথা বলে আসছে। এদিকে বিএনপি ও তাদের মিত্র কয়েকটি দল মনে করছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও আইনি ভিত্তি নিয়ে যে দাবি উঠেছে, সে বিষয়ে আবারও আলোচনা হতে পারে। বিএনপি সে বিষয়ে একমত। তবে এর সঙ্গে নির্বাচন টেনে আনার কিছু নেই। কারণ নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানানো হয়, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ চূড়ান্ত এবং বাস্তবায়নের উপায় বিবেচনা করতে এরই মধ্যে কয়েকটি বৈঠক করেছে কমিশন। এতে সনদ চূড়ান্ত করা এবং বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নির্ধারণে ইতোমধ্যে দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া পরামর্শ ও সুপারিশমালা পর্যালোচনা করা হয়। গতকাল কয়েকটি দল এ বিষয়ে মতামত জমা দিয়েছে। এসব মতামত বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করতে ইতোমধ্যে ২৮টি দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। এ প্রক্রিয়ায় কমিশন দলগুলোর কাছে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে মতামত আহ্বান করে। গতকাল পর্যন্ত ২৬ দলের পক্ষ থেকে মতামত পাওয়া গেছে।