বাংলাদেশের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের অবদান কতটুকু? এই প্রশ্নের উত্তর সচেতন মহলমাত্রই অবগত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৯৩ শতাংশ আনা-নেওয়ার কাজ হয় এ বন্দর দিয়ে। সমুদ্রপথে কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ৯৮ শতাংশ হয় এ বন্দর দিয়ে। ৬৫ শতাংশ রাজস্ব আহরিত হয় বন্দর ও কাস্টমসের মাধ্যমে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। অথচ সেই চট্টগ্রামে নেই কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হয়েছে। কত সরকার গেল, এলো। কিন্তু গড়ে ওঠেনি বিশেষায়িত হাসপাতাল। অথচ রাজধানী ঢাকাতে আছে বিভিন্ন রোগের সেবা ও গবেষণায় ১১টি বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউট। কিন্তু চট্টগ্রাম কেন পিছিয়ে। ৫৪টি বছর পার করার পরও কেন একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল হলো না? এর দায় কার? চট্টগ্রামের রাজনীতিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা- কেউ কি এই দায়বদ্ধতা এড়াতে পারবেন? সময় এসেছে এর হিসাব কষার। আজকের প্রজন্ম এই হিসাব চাইতেই পারে।
দুই. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দেশের বিভাগীয় শহরে ‘ফিজিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট’ (পিএফডি) শীর্ষক অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় ২ একর জমিতে ২০০ শয্যার একটি করে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয়কে জায়গা খুঁজে বের করতে বলা হয়। পরে নগরের বাকলিয়া মৌজার কর্ণফুলী সেতুসংলগ্ন সরকারি জায়গা নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ জায়গাটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়। কিন্তু ভূমির একটি অংশে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) কর্ণফুলী রিভার ফ্রন্ট রোড এবং সওজ কর্ণফুলী সেতুর সংযোগ সড়ক বাস্তবায়ন করায় আপত্তি তোলে। ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর নির্ধারিত ভূমি থেকে শূন্য দশমিক ৫৪ একর বাদ দিয়ে ১ দশমিক ৪৬ একরে হাসপাতাল নির্মাণে অনুমতি দেয় চউক। ইতোমধ্যে তৈরি হয় নকশা। কিন্তু ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জেলা প্রশাসন এ জায়গায় স্পোর্টস অ্যারিনা তৈরির ঘোষণা দেয়। এ নিয়ে ওই বছরের ১৬ জানুয়ারি সিভিল সার্জন কার্যালয় জেলা প্রশাসককে ‘প্রস্তাবিত ২০০ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের ভূমিতে স্পোর্টস অ্যারিনা তৈরি না করার জন্য’ চিঠি দেয়। বিষয়টি এখনো এমন অবস্থায় আছে। অথচ বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা। কিন্তু এখনো জমিই নির্ধারণ করা হয়নি। প্রশ্ন আসে- অবশেষে শিশু হাসপাতালটি হবে তো? নাকি ভূমি জটিলতা, স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলায় প্রকল্পটিই বাতিল হয়ে যাবে? যদি বাতিল হয়, তাহলে এ দায় কার? কেউ কি দায় এড়াতে পারবেন? স্বাস্থ্য বিভাগের কেন এত গড়িমসি। একটু আন্তরিক হলেই তো একটা জায়গা খুঁজে বের করা যায়।
তিন. দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করে। চট্টগ্রামেও প্রতিনিয়তই বাড়ছে শিশু, বাড়ছে শিশু রোগী। কিন্তু চট্টগ্রামে রোগীর তুলনায় শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র অত্যন্ত অপ্রতুল। বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষকে নির্ভর করতে হয় চমেক হাসপাতালের শিশু বিভাগের ওপর। এ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে অনুমোদিত শয্যা ৩৪টি। অতিরিক্ত সংযুক্ত করা হয় ১০০টি। কিন্তু এখানে নিয়মিত গড়ে চিকিৎসা নেয় ২০০-২৩০ জন। শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের শয্যা ১০০টি। এখানে নিয়মিতই শয্যার বাইরে ফ্লোর-বারান্দায় রোগী ভর্তি থাকে। হাসপাতালের শিশু বিভাগে প্রতিদিন আউটডোরে চিকিৎসা নেয় ২৫০-৩০০ রোগী। তা ছাড়া, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যা আছে ৫২টি। এখানে আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ শিশু রোগী চিকিৎসা নেয়। আছে জনবল, চিকিৎসা উপকরণ ও যন্ত্রপাতি সংকট। প্রধান দুই হাসপাতালে শয্যাসংকটে শিশু রোগীদের চিকিৎসায় বিপাকে পড়তে হয়। শীতকালে শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু রোগীরা অনেক সময় সুস্থ হওয়ার বিপরীতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেঝে-বারান্দায় ভর্তি থাকা রোগীদের জীবাণু সংক্রমণের শঙ্কা তৈরি হয়। ডায়রিয়া-শীতকালীন রোগ কিংবা অন্য কোনো শিশু রোগ দেখা দিলে বাড়ে চাপ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে আছে প্রায় ৩০০টি সাধারণ শয্যা, ৫০টি শিশু আইসিইউ এবং ৮২ শয্যার এনআইসিইউ। এ হাসপাতালটিও শিশু চিকিৎসায় বিশেষ অবদান রাখছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত শিশু রোগী বৃদ্ধির বিপরীতে এসব সেবা অপ্রতুল। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও কেন চট্টগ্রামে কোনো বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মিত হয়নি। একটি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণের সুযোগ এলেও তা কেন বাস্তবায়ন করা হয়নি? চট্টগ্রামে যদি একটি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মিত হতো, তাহলে শিশু রোগীদের কি এত ভোগান্তি পোহাতে হতো? কিন্তু কেন হয়নি? তবে গতানুগতিক ধারায় বলা যায়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দাপ্তরিক অবহেলা এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের আন্তরিকতার অভাবে কাজটি আলোর মুখ দেখছে না। এটি দুঃখজনক।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী